বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস। -আইনুল বারী

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ
ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস।
-আইনুল বারী
-----------------------------------------------------------------------------------

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে বাংলাদেশে ও ভারতবর্ষে মাদক বাণিজ্য ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবন - --- বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের এ ছিলো এক কালো অধ্যায়। যখন পরাক্রম সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির দানব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী চীনে ও ভারত বর্ষের মতো দরিদ্রপিড়ীত এশীয় ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলিতে নানা কৌশলে, খবরদারির মাধ্যমে মাদকের জাল বিস্তার করেছিলো। এক দিকে জোরপূর্বক আফিম চাষ করিয়ে আফিমের উৎপাদন বৃদ্ধি করেছিলো, আবার আফিমের নেশাখোর/সেবনকারী তৈরি করে সেখানেই আফিমের বিরাট বাজার তৈরি করেছিলো। লোকালয়ে গাঁজা, মদ-আফিমের অসংখ্য দোকান খুলে মাদক বাণিজ্যকে অবারিত করা হয়েছিলো, মাদকের বৃহত্তর বাজারে পরিণত করা হয়েছিলো ভারত-বর্ষ ও চীনকে।
(২) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বণিকেরা ভারতবর্ষ-চীনকে ঘিরে মাদক বাণিজ্যের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এ নেটওয়ার্ক স্বল্প সময়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির রক্তপ্রবাহী শক্তিশালী ধমনী হয়ে ওঠে। ভারতে নিজেদের শাসনে-খবরদারির মাধ্যমে উৎপাদিত আফিম চীনে উচ্চ শুল্কে বিক্রি করতে থাকে। এ চিত্র কতো ভয়াবহ তার প্রমাণ চীনের আফিম যুদ্ধ। কোম্পানির অপকর্মের ফলশ্রুতিতে চীনে শুরু হয় আফিম যুদ্ধ( ১৮৩৯-১৮৪২) । চীনের স্থানীয় শাসকদের মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি বুঝতে চীনের তৎকালীন কমিশনার লিনের (Commmissioner Lin Zexu, 1839 ) একটি মন্তব্য উল্লেখ করাই যথেষ্টঃ ‘…there is a class of evil foreigner that makes opium and brings it for sale, tempting fools to destroy themselves, merely in order to reap a profit.’

চীনের চায়ের বিরাট চাহিদা ছিলো ইউরোপের বাজারে, কিন্তু চীনের সে চা দিয়ে কীভাবে ভাগ্য গড়বে বৃটেনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি? যা বৃটেনের সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিকে মজবুত রাখবে? চীন চায়ের বিনিময়ে চায় রুপা, চীনকে রূপা দিতে দিতে বৃটিশ রাজ রূপার সংকটে পড়ে, তখন রূপার বদলে এমন এক বিনিময় খোঁজে যা দিয়ে চীনের রুপার ক্ষুধা বন্ধ করা যায়, আর তা হলো আফিম। কেননা চীনে আফিমের অল্প বিস্তর প্রচলন ছিলো আগে থেকেই, বিশেষত চিকিৎসার জন্যে , এখন শুধু প্রয়োজন আফিমের সেবন বাড়িয়ে বিরাট মানুষের দেশ চীনে মাদকাসক্তির সঞ্চার ঘটানো। আফিম আসবে কোথা থেকে, ভারতে এর চাষ হবে, আর সেখান থেকে বৃটিশ পরিবহনে, বৈধ-অবৈধ পথে চীনে যাবে।
আফিম যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর থেকে শাসনভার হাতে নেয় বৃটিশ রাজ, কিন্তু মাদক বাণিজ্যের ধারবাহিকতা বজায় রাখে। বিভিন্ন আইন প্রবর্তন করে গাঁজা, মদ, আফিম থেকে রাজস্ব আদায় শুরু করে ও বিপুল পরিমাণে রাজস্ব আদায় করে নেয়।
আফিম চাষে, নীল চাষে বাধ্য করা হয়েছিলো শিল্প বিপ্লবের বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনের জন্যে। নানা উপায়ে সম্পদ লুন্ঠন ও মাদক বাণিজ্যের মাধ্যমেই সেটি সম্ভব করে তুলেছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকেরা।

(৩) এ শুধু কথার কথা নয়, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ,বই-পুস্তকেই সেসবের তথ্য-প্রমাণ রয়ে গেছে, যা আজো মুছে ফেলা যায়নি। ১৭৯৩ খৃষ্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিশের ( Lord Cornwallis ) সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী্র বাণিজ্যিক স্বার্থে আরোপিত হয় চির স্থায়ী বন্দোবস্ত, ভূমি কর আদায়ের জন্য তৈরি করা হয় সূর্যাস্ত আইন, যা পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে জমিদারী বন্দোবস্তের প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়িত হতে থাকে , ১৭৯৩ সালে দশসনা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রুপান্তরিত করা হয় । চির বন্দোবস্ত আর যাই হোক এ অঞ্চলের কুটির শিল্পের বিকাশ ও দেশীয় বাণিজ্যের ধারাকে সার্থকভাবে বাধাগ্রস্ত করতে পেরেছিলো, এ সময় প্রায় ২ কোটি ক্ষুদে জোতদার-চাষী উচ্ছেদ হয়েছিলো আর কোম্পানীর অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের চাপে শিল্পায়নের দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগগুলি পঙ্গু অথবা বিনষ্ট হয়েছিলো। একই সাথে নিজেদের শাসন-শোষনের অনুকূলে এক তাঁবেদার জমিদার শ্রেণী তথা বাবু সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছিলো, যারা প্রায় পরবর্তী দু’শ বছর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণকে ভারতবর্ষে টিকিয়ে রাখতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিলো।
চির স্থায়ী বন্দোবস্তের কয়েক দশক পূর্বে, ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া রাজ ক্ষমতা দখলের পর তৎকালীন বাংলায় ( বাংলা বিহার উড়িষ্যা ) সরাসরি কোম্পানী শাসন চাপিয়ে দিয়ে জমির খাজনা তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়, আর তখন এমন এক দূর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয় ( ১৭৭০খ্রি., ১১৭৬ বঙ্গাব্দে, একে 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' বলা হয় ) যাতে বাংলার মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই শেষ হয় (অনুঃ ১ কোটি মানুষ)। আর এই সময় থেকেই বৃটেনে শিল্প বিপ্লবের (১৭ ৫০ এর দশক থেকে অনুমিত) সুচনা হয়, যা পরবর্তীতে পুরো ইউরোপকে শিল্পায়নের আতিশয্যে জাগিয়ে তোলা সম্ভব হয়। তখন থেকে বৃটেনের অর্থনীতি সস্তা ভারতীয় শ্রমের কারিগরে টেক্সটাইল বাণিজ্য থেকে বৃহত্তর পোশাক শিল্পের বাণিজ্যে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে, একই সাথে বহুগুণে বাড়ে পোষাক উৎপাদন ও ভারতীয় ও এশীয় সস্তা পণ্যের বিশালাকার বাজার। আর পর পর দুর্ভিক্ষ চলতে থাকে ভারতবর্ষে, ১৮৭৬ থেকে ৭৮ খৃস্টাব্দে সংঘটিত হয় মহা দুর্ভিক্ষ। ধারনা করা হয় এতে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়।
(Engraving from The Graphic, October 1877, showing the plight of animals as well as humans in Bellary district, Madras Presidency, British India during the Great Famine of 1876–78.)
( a photograph of a famine stricken mother with baby who at 3 months weighs 3 pounds. Photographer: W. W. Hooper. Great Famine of 1876–78)
(১৮৭৭ সালে তোলা ছবিতে ব্রিটিশ ভারতের মহা দুর্ভিক্ষ।)

(৪) বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলদারি রাজত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এ দেশের মানুষ। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে ব্যারাকে ব্যারাকে মুসলিম-হিন্দু সৈনিকদের মাঝে অভূতপূর্ব এক বিদ্রোহ দেখা দেয়, যার নাম সেপাহী বিপ্লব, এর ফলাফল ছিলো সুদূরপ্রসারী। কেননা কোম্পানির সেনা বহরে অফিসার পদ ছাড়া সধারণ সৈনিকদের মধ্যে কম পক্ষে ৮০%-ই ছিলো ভারতীয়, বৃটিশ সেনা বহরে জনবলের সংখ্যা ছিলো প্রায় ২ লক্ষের মতো। বিদ্রোহীরা অনেক বৃটিশ সেনা অফিসার, সাধারণ লোক ও বৃটিশদের পক্ষ নেয়া লোকজনকে হত্যা করে, আর নিজেদের পক্ষে অসংখ্য হত্যার শিকার হয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের যবনিকাপাত ঘটে ১৮৫৮তে, তবে বৃটিশ সরকার কোম্পানিকে বহিষ্কার করে ভারতের শাসনভার নিজেদের হাতে নেয়। আর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের জন্যে পর্যাপ্ত পুঁজির বিকাশে সম্পদ লুন্ঠনের ও বাজার সৃষ্টির কর্মকান্ড অব্যাহত থাকে। (মন্তব্যঃ ছবিগুলি ইন্টারনেট থেকে বাছাইকৃত।)

Comments

Popular posts from this blog

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

যদি এমন হতো? -আইনুল বারী