ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ
অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন 
--- --- --- ----

নাস্তিক্যবাদ  ক্ষমতার অণু-বিশ্লেষণ করে বস্তুবাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক ল্যাবরেটরিতে, মানুষের জাগতিক ক্ষমতা-সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো রকম ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া।                                 

ক্ষমতা তাই, মানুষের সামাজিক সম্পর্কের ফসল মাত্র।  ক্ষমতা মানুষের সৃষ্টি, এবং এর দায়-দায়িত্ব কেবল মানুষের উপরই বর্তায়। মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণে ‘ক্ষমতার’ শ্রেণী-চরিত্র আছে। আদিম সাম্যবাদী যুগের যৌথ স্বার্থের সামাজিক সম্পর্ক ভেংগে যখন থেকে সম্পদের উপর ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব ঘটলো, ঐতিহাসিক বিকাশের পথ ধরে, আর শ্রেণী বিভক্ত সমাজে মানুষের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ধরণও পাল্টাতে শুরু করলো; ক্ষমতারও চারিত্রিক রূপান্তর ঘটতে থাকলো । মার্কসীয় মতবাদ অনুসারে শ্রেণীগত ক্ষমতা ব্যক্তিগত ক্ষমতার চেয়ে ক্ষমতাবান, ব্যক্তি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে নিজের ক্ষমতাকে স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারে না, যতোক্ষণ না শ্রেণীচ্যুত হয়। আন্তনীয় গ্রামসি  হেজিমনি তত্ত্ব দিয়ে ক্ষমতাকে খানিকটা ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তি সিভিল সমাজের উপর ক্ষমতার হেজিমনি আরোপ করে টিকে থাকে ও কীভাবে হেজিমনি হারিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়। আরও আগে জেরমি বেন্থাম(১৭৪৮-১৮৩২) বুদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের অধীনে প্যান-অপটিক সোসাইটির কথা বলেছিলআন। আর মিশেল ফুকো ক্ষমতা তত্ত্বে প্রয়োগ করেছেন এক অভূতপূর্ব দার্শনিকবোধ। ফুকো ক্ষমতাকে দেখতে চেয়েছেন সৃষ্টিশীল বস্তু হিসেবে, যেখানে ক্ষমতা একটি উৎপাদনযোগ্য বিষয়। ক্ষমতা বিষয়ে জেরমি বেন্থাম, ম্যাকিয়া ভেলী, হবস, ম্যাক্স ওয়েবার, নীটশে, স্টিভেন লুক, এন্থনি গিডেন্স, মান ও আরও অনেক দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিক, অর্থনীতিবিদ, এমনকি সমর বিজ্ঞান বিশারদগণ যুগে যুগে নানা অঙ্গিকে ভেবেছেন ও নানা তত্ত্ব দিয়েছেন। কিন্তু আমার এই ছোট্ট রচনায় সে সবের গভীরে অনুসন্ধানে যাবো না। বরং পাশ্চাত্যের প্রভাবশালী চিন্তাবিদদের ক্ষমতা বিষয়ক চিন্তার মূলধারার মূল বক্তব্যকে  সরলীকরণ করে বুঝে নিতে চেষ্টা করবো এই যেঃ ক্ষমতা হলো বিভিন্ন সভ্যতায় মানুষের আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের ফলাফল, যা জটিল সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্রমে জটিল হয়ে উঠছে, যেখানে ক্ষমতার অধিক্ষেত্র হিসেবে অনড় থেকেছে মানুষের সমাজ, এর রচিয়তা মানুষই।

যদি ক্ষমতার বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে অণু-বিশ্লেষণ করি, দেখতে পাবো, আমাদের সমাজে ব্যক্তি মানুষকে ঘিরে ক্ষমতার যে আস্তরণ, তার বহু মাত্রিকতা রয়েছে। যদি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে আলাদা আলাদা বর্ণে চিহ্নিত করি তবে ব্যক্তি-মানুষ নানাভাবে নানা বর্ণে বর্ণিল হয়ে উঠতে পারে। ক্ষমতার আরাধোনায় ব্যক্তি মানুষের এইরূপ বর্ণিল হয়ে উঠার মধ্যে একাকী বড় হয়ে উঠার তীব্র স্বার্থপরতা রয়েছে। কেননা ক্ষমতা যার কাছে সঞ্চিত/অর্জিত হচ্ছে, তার মানে হচ্ছে তার স্বার্থপর ক্ষমতার কাছে কেউ পদানত হচ্ছে, যার উপর ক্ষমতা চর্চিত হবে। এখানে বলে রাখা ভালো, ক্ষমতা দায়িত্ব থেকে ভিন্ন বলেই ক্ষমতা ও দায়িত্বের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পুঁজিবাদী-ভোগবাদী সমাজে ব্যক্তি মানুষকে সেলিব্রেটি করে তুলতে চায়, ভোগের বাজারকে বিস্তৃত করার জন্যে, এই সেলিব্রেটির রহস্য হলো, পার্থিব জীবনে অজস্র মানুষ- দেবতা ও দেবীর জন্ম দেয়া। আর মানুষ-দেব-দেবীদের পূজারীর প্রয়োজন হয় বলেই তাদের ক্ষমতাবান হয়ে উঠা জরুরি। এই যে দেবত্ব আরোপের মতো আত্মকেন্দ্রিক ক্ষমতার অনুশীলন চলছে, তা অনিবার্যভাবে সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। কোটি কোটি ব্যক্তি মানুষ ব্যক্তি স্বাধীনতার অজুহাতে নিজ নিজ অভিরুচি অনুসারে জীবন যাপনে ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে বা করতে চায়। বস্তুবাদী দর্শনের মানবতাবাদ এই বিপর্যয় থামাতে পারে না, কেননা যখনই ক্ষমতাকে নীতি হিসেবে মানুষের হাতে ছেড়ে দে্যা হয় তখনই ব্যক্তির স্বার্পরতা এর সাথে জড়িয়ে পরে।

বস্তুবাদী জীবন দর্শনে মানুষ নিজেই নিজের ভবিতব্যের সৃজনকর্তা ও মুক্তিদাতা। তাই যে অন্যের ক্ষমতার দ্বারা পিষ্ট হচ্ছে তার নির্ভর করার মতো নিজেকে ছাড়া কেউ নেই। তার নিজেকেই ক্ষমতার কামড় থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটি সম্ভব একটি উপায়ে, নিজেকে অন্যের তুলনায় ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে হবে। ক্ষমতার এ লড়াই শুধু শ্রেণী-সংঘাত দিয়ে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা যায় না, এ হচ্ছে ব্যক্তি মানুষের সাথে ব্যক্তি মানুষের ক্ষমতার লড়াই। এ লড়াই সামজিক সম্পর্কের ভেতরকার বুননে, সামজিক সত্তার রসায়নে তার আণবিক সংগঠনে অস্থির অণুগুলিতে অসুখের মতোই সংক্রামিত হয়েছে।
অন্যদিকে, বিশ্বাসের ক্ষমতা দর্শন একেবারে ভিন্ন কথা বলে।


এখানে মানুষের ক্ষমতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে, ব্যক্তি মানুষের ক্ষমতা হোক বা সংঘবদ্ধ/শ্রেণীগত ক্ষমতা হোক। সৃষ্টিজগতে কেবল ঐশ্বরিক ক্ষমতার  অধিক্ষেত্র রয়েছে। একমাত্র ঈশ্বর বা আল্লাহই সকল ক্ষমতার উৎস; তাঁরই প্রদত্ত সীমিত ক্ষমতা(যদি তাকে ক্ষমতা পরিভাষাতেই বুঝতে চাই) যা প্রকৃত অর্থে দায়িত্ব, তা দিয়েই আমাদের মানবিক সম্পর্ক রচনা করতে হয়। যেহেতু ক্ষমতা একটি সৃষ্টকর্তা প্রদত্ত অর্পিত দায়িত্ব বা অনুগ্রহ মাত্র, তাই এই ক্ষমতা মানুষের মনে অহংকার বা স্বার্থপরতা তৈরি করতে পারে না, বরং দায়িত্বের বোঝা হয়ে চেপে থাকে আমৃত্যু। যখন একজন মানুষ এটি ভালোভাবে বুঝতে পারে যে মানুষ, শ্রেণী বা রাষ্ট্রের নিজস্ব ক্ষমতা বলে প্রকৃত অর্থে কিছু নেই, তখন তার নিজের জন্যে ক্ষমতাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও তা অর্জনের জন্যে অন্যের সাথে লড়াই করার মনোভাব ও চেষ্টাও থাকবে না। মানুষ অন্যের কল্যাণের মাঝেই নিজের কল্যাণ অর্জনের জন্যে দায়িত্ব পালন করে যাবে। ব্যক্তি মানুষের সামাজিক সম্পর্কগুলি তখন পাল্টাতে থাকবে, এবং নতুন জীবন দর্শনের জন্ম নিবে। এই নতুন জীবন দর্শন এমন এক প্রশান্তিদায়ক মানবতাবাদী সভ্যতায় মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে তা, এ মুহূর্তে সত্যি অকল্পনীয়।

Comments

Popular posts from this blog

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস। -আইনুল বারী