ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- ইতিহাস পাঠ
-আইনুল বারী
৫/১২/২০১৭
 -- -------------- --- --------------------------



 আমরা প্রায়শই প্রতারণা, প্রবঞ্চনা বোঝাতে 'ঠগ', 'ঠগী' 'ঠগবাজি' শব্দ ব্যবহার করি। 'ঠগ' একটি সংস্কৃত শব্দ যা থেকে 'ঠগী' শব্দটি অনুসৃত হয়েছে, ঠগ,ঠগী, ঠগবাজি, ঠক, ঠকানো শব্দগুলি বাংলা ভাষাতেও জায়গা করে নিয়েছে। অতীতে ঠগীরা যখন লোকালয়ে বিচরণ করতো, তখন ওদের পরিচিতি ছিলো 'ফাঁসিগর' হিসেবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজরা ঠগ/ঠগী শব্দটি তাদের ডিকশনারীতে ঢোকালো ১৮৩০ এর দিকে, Thug, Thugi (Thuggee) এমনভাবে বানান করে, যার অর্থ সংঘবদ্ধ ডাকাত দল, লুন্ঠনকারী, দস্যু ইত্যাদি। এর সাথে প্রতারক, ছলনাকারী অর্থটিও জুড়ে দেয়া হয়েছিলো, কেননা ঠগী সম্প্রদায়ের লোকেরা চালাকি করে টার্গেট পথচারীদের সাথে অন্তরঙ্গতা তৈরি করতো ও তাদের পথ চলার সংগী হতো, তারপর অনুসরণ করতে করতে সময় মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সম্পদ ও টাকা পয়সা লুট করে তাদেরকে মেরে ফেলতো। এখনও Thug শব্দটির বহুল ব্যবহার বিদ্যমান, গুন্ডা, সন্ত্রাসী এসব বোঝাতে।

এই ঠগীদের ইতিবৃত্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গেলে ইতিহাসের পাতায় প্রথমত ও প্রধানত ইংরেজদের লেখালেখি, আইন-কানুনগুলিই জড়ো হতে থাকে, ইন্টারনেটের কল্যাণে পিডিএফ আকারেই তথ্যের স্তুপ জমা হয়ে যায় এক মূহূর্তে। এরা ছিলো নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী, ডাকাত দল ইত্যাদি, তেরো শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত এরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। উত্তর ভারত, মধ্য প্রদেশ ছিলো এদের মূল আস্তনা। কিন্তু আজকাল ঔপনিবেশিক আমলের শাসক শ্রেণীর রচনার ব্যাপারে চোখ-কান খুলে যাওয়া এশিয়া-আফ্রিকার প্রাচ্যের সত্য অনুসন্ধানকারীদের গুরুতর অভিযোগ ও যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে। যাক, সে ভিন্ন কথা।
১৮ শতকের প্রথম দশকেই এদের সম্পর্কে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সরকার জানতে পারে, যা অচিরেই তাদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠে। ১৮১২ সালের দিকে গঙ্গার ধারে একটি গণকবরে ৫০টি লাশ পাওয়া যায়, লাশগুলি ভালোভাবে পরীক্ষা করে অনুমান করা হয় কোনো সংঘবদ্ধ ভয়ংকর গোষ্ঠী অত্যন্ত সতর্কতার সাথে হত্যাকান্ড ঘটিয়ে লাশগুলি মাটিতে পূঁতে রেখেছিলো যেনো দ্রুত পচে মাটিতে মিশে যায়। এই গণহত্যার পেছনে কারা রয়েছে, তাদের মোটিভ কী, তা খুঁজতে তৎকালীন বৃটিশ পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসন তৎপর হয়ে উঠে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উইলিয়াম স্লিম্যান সর্বপ্রথম এর পেছনে ঠগীদের সম্পৃক্ততা দেখতে পান। তিনি ঠগীদের কর্মকান্ড, মডাস অপারেন্ডি, হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ইত্যাদি সম্পর্কে সরকারকে সবিস্তারে জানান ও এদের নির্মূলের দায়িত্ব গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার সূত্র ধরেই পরবর্তীতে পাশ্চিমা সভ্য দুনিয়া জানতে পারে যে, এই ভারত বর্ষে এক পিশাচ শ্রেণীর ধর্মীয় সম্প্রদায় (Cult) বিদ্যমান আছে যা্রা কিনা এক ভয়ংকর কালী দেবীর আরাধোনা করে, দেবীর সন্তুষ্টির জন্যে মানুষ বলি দেয় তারা। মজার ব্যাপার এই ঠগী সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সবাই কিন্তু ছিলো। এরা খুব গোপনে কাজ করতো ও ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে, প্রতারণার মাধ্যমে পথিকদের সাথী হয়ে তাদেরকে অনুসরণ করে সুযোগ মতো আক্রমণ চালা্তো, সম্পদ লুন্ঠন করতো, তারপর ভিক্টি্মকে রুমাল দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে মাটিতে পুঁতে রেখে হাওয়া হয়ে যেতো। পথিক লোকটির আর খোঁজ থাকতো না, গুম ও হত্যার এই প্রক্রিয়া বছরের পর বছর চলতে থাকে, কেউ কিছু টেরই পায় না। গোপনীয়তার ব্যাপারে ঠগীরা এতোটাই সতর্কতা অবলম্বন করতো যে পুরুষরা ছাড়া কেউ সদস্য হতে পারতো না, ঠগী পরিবারের মেয়েরাও কেউ জানতো না তাদের পুরুষটি কী করছেন। তারা বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করতো, কখনো পথ চিনিয়ে দেয়ার নাম করে বা নিজেকে সৈনিক বলে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে পথচরীর সঙ্গী হতো, কখনো আবার তীর্থযাত্রী হিসেবে। একজন টার্গেটকে হত্যার অপারেশনে সাধারণত তিনজনের একটি দল অংশ নিতো, একজন মাথার দিকে থেকে হাত ধরে রাখতো, একজন গলায় ফাঁস পড়াতো, আরেকজন পা চেপে ধরতো। এছারা কাছাকাছি আরেকটি দল পাহাড়ায় থাকতো প্রয়োজনে এগিয়ে আসার জন্যে ও নিরাপদ প্রস্থানের জন্যে। তারা সাংকেতিক ভাষাও ব্যবহার করতো, যেমন ‘বাসন মেজে আন’, এ ছিলো হত্যা করার সংকেত। এই গুপ্ত ঘাতক গোষ্ঠী (silent killers) টার্গেটের ব্যাপারে হাট-বাজার, সরাইখানা থেকে আগাম তথ্য জোগাড় করে নিতো। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত বৃটিশ ইন্ডিয়ার তৎকালীন সরকারী রেকর্ড মতেই ঠগীদের দ্বারা প্রতি বছর গড়ে ৪০ হাজারের মতো গুম ও হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটিছিলো বলে জানা যায়। ১৮৩০ থেকে ১৮৪০ পর্যন্ত ৩,৭০০ ঠগী ধরা পড়ে, এর মধ্যে ৫০০ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়।
১৮৩০-এ স্লিম্যানের প্রবন্ধে প্রকাশ পায়, 'is an organized system of religious and civil polity prepared to receive converts from all religions and sects and to urge। এ সময়ই অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে 'ঠগ' শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে(Thug), যার নতুন সমার্থক শব্দের তালিকায় যোগ হয় 'সন্ত্রাস, সন্ত্রাসী'। তারা কালো তালিকাভুক্ত হয় ইতিহাসের ভয়ংকরতম সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে। ১৮৩০ এর দশকে স্লিম্যানের নেতৃত্বে পুলিশ ও প্রশাসনের প্রচেষ্টায় ঠগীদের নির্মূলের কৃতিত্ব দাবী করা হয়। ১৮৩৬-৪৮ এর মধ্যে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের অধীনে বিভিন্ন কঠোর আইন (Thuggee Act,1836) জারি করা হয়। ১৮৭১ সালে জারি করা হয় Criminal Tribe Acts। আমীর আলী নামের একজন ঠগীর স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে ফিলিপ মেডৌজ টেইলর (Philip Meadows Taylor ) নামের একজন সাহিত্যিক 'Confessions of a Thug' নামেতো একটা উপন্যাস লিখেন, ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে। আর এ যুগে আশির দশকে Indiana Jones and the Temple of Doom নামের হলিউড সিনেমা নির্মিত হয়, যেখানে ঠগী সম্প্রদায়কে চিত্রিত করা হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মনস্তত্ত্বে ও রচিত সাহিত্য থেকে বেছে নেয়া উপকরণে।
তবে যারা প্রাচ্যবাদী গবেষক, যারা সাব-অল্টার্ন লেখালেখি করেন তারা মনে করেন, ঐতিহাসিকভাবে বিবর্তিত হয়েছে এই 'ঠগী' চরিত্রের রূপায়ন। বলিদানের গোপন আচার-অনুষ্ঠান পালনকারী ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে এক করে দেখিয়ে বৃটিশ দখলদার শাসক শ্রেণী ঠগীদের উপর জোর করে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছিলো কিনা তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তথ্য-উপাত্ত-সাহিত্য বলে এই ঠগী শ্রেণীর লোকেরা অনেক ক্ষেত্রেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আজ্ঞাবাহ সেপাহীদের উপর আক্রমণ চালাতো, তাদের অর্থকড়ি কেড়ে নিতো, আর যেসব ব্যবসায়ীরা বৃটিশ কোম্পানীর সামরিক বাহিনীকে ঘোড়া ও অর্থ লেনদেন করতো তারাই ছিলো প্রধান টার্গেট। তবে তারা সবাইকে হত্যা করতো না, বিশেষ করে ফকির শ্রেণীর লোক, গায়ক, নৃত্যশিল্পী, অসুস্থ, কুষ্ঠ রোগী, নিচু জাতের পেশাজীবী শ্রেণীর লোকজন যেমন কামার,কুমার, কাঠ মিস্ত্রী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, গঙ্গাজল বাহক, গরীব মেয়েদের হত্যা করতো না। কাজেই এদেরকে শয়তানের পূজারী ও নৃশংস খুনী ইত্যাদি বিশেষণে সংজ্ঞায়িত করে ৫/৬ শত বছর আগের দস্যু দল বা কোনো ধর্মীয় ত্রান্ত্রিক গোষ্ঠীর সাথে মিলিয়ে ফেলা কতোটা বাস্তব সত্য ছিলো, আর তাতে কতোটা অজ্ঞতা, কল্পনা ও উদ্দেশ্য নিহিত ছিলো সে ব্যাপারে নিশ্চয় আজো একাডেমিক বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। আর যখন ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে বৃটিশ দখলদারির বিরুদ্ধে ভারতীয়দের স্বদেশী আন্দোলনকেও সন্ত্রাসবাদের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছিলো।
আধুনিক যুগে এসে ইতিহাস পাঠে প্রাচ্যবাদের প্রভাবে পশ্চিমাদের নির্মিত শোষন-বঞ্চনার ইতিহাসকে নতুন চোখে দেখার ও তার পাঠোদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এ ধারার সাব-অল্টার্ন চর্চাকারীরা কিন্তু বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীওয়ালাদের ঠগ প্রতিরোধ সংস্থর প্রধান উইলিয়াম স্লিম্যান ও তার সহযোগীদের ধূর্তামির চোখে ঠগীদের স্রেফ 'শয়তানের পূজারী' অপরাধী গোত্র, বা ডাকাত গ্যাং বা খুনে- লুন্ঠনকারী- সন্ত্রাসী হিসেবেই মেনে নেয়নি। বরং তারা ইতিহাসের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন এসবের সাথে মিশে ছিলো স্লিম্যান গোষ্ঠীরই ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্বের ছাপ, কিছু অপব্যখ্যা ও অবমূল্যায়ন। আরও সিরিয়াস গবেষণার সুযোগ রয়েছে বৈকি, কোনো নির্দিষ্ট কালপর্বে কেনো এমন গুপ্ত হত্যার ঘটনাগুলি(silent killing) ঘটছিলো? তারা কি ছিলো কোনো তান্ত্রিক গোষ্ঠী নাকি বৃটিশ বিরোধী গোপন সংগঠন? নাকি স্রেফ সম্পদলুন্ঠনকারী ডাকাত বা দস্যু দল? আজ আমরা ঠগীদের বিষয়ে যতোটুকু জানি, কাল হয়তো আরও জানবো, এভাবেই বেরিয়ে আসবে, যা জেনেছি তার পুরোটাই হয়তো সত্য নয়, অথবা কিছুটা সত্য ও কিছুটা ঠগবাজি।
(মন্তব্যঃ লিখতে গেলে লেখা শেষ হতে চায় না, অনেক কিছু প্রশ্ন আকারে বাকি রয়ে গেল। তাই সেসবের উত্তর খুঁতে আরও লিখবার আশা রইলো।)

Comments

Popular posts from this blog

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস। -আইনুল বারী