'রাগ' প্রবৃত্তির শাসন ও তাকে প্রশমনের উপায় -আইনুল বারী

'রাগ' প্রবৃত্তির শাসন ও তাকে প্রশমনের উপায়
-আইনুল বারী
-------------------------------------------------------------------------------------

(১) রাগ, আমাদের একটি মৌলিক আবেগ, প্রবৃত্তি। শক্তিশালী প্রবৃত্তির শাসনে আমরা চলি, 'রাগ'-ও তার একটি।   
বিবর্তনের পথে বিভিন্ন প্রবৃত্তির মতো মানুষ 'রাগ'কে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে। আদি মানুষ যদি প্রবৃত্তিকে কিছু মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে না শিখতো তবে সভ্যতার সৃষ্টি হতো না, সামাজিক বন্ধন রচনা করে সে সভ্যতা এগিয়েও চলতো না। দ্বিতীয় পর্যায়ে 'ভাষা'  প্রবৃত্তিকে বহু মাত্রায় প্রকাশ করতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে শিখিয়েছে। ভাষা রাগকে স্পষ্ট করেছে, রঙিন করেছে, বৈচিত্রময় করেছে, বোধগম্য করেছে। প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ ও ভাষার ব্যবহার মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে রেখেছে। 

যখন 'ভাষা'র উদ্ভব ঘটলো তখন 'রাগ’-ও তার বৈচিত্রপূর্ণ আত্মপ্রকাশের জন্যে ভাষাকে অবলম্বন করলো।       
সভ্যতার বিভিন্ন পর্বে, বিভিন্ন আবাসভূমিতে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে, বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসে মানুষ 'রাগ' প্রবৃত্তিকে প্রয়োগ করেছে বিভিন্ন উচ্চারণে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে। আজো একইভাবে 'রাগ'-এর ক্রমধারা চলছে।


(২) কিন্তু অনেক সময় আমরা 'রাগ'কে বুঝতে ভুল করি । অবুঝের মতো ভাষা থেকে রাগকে আলাদা করে ফেলি। সামাজিক তুলনার নিক্তিতে মেপেও দেখি না। যেমন একজন লোক যখন ভীষণ রেগে গেছে, তখন সে হয়তো চীৎকার দিয়ে ওঠে। তার ‘চীৎকার’ আর কিছু না,  তার ‘রাগের গভীরতা’ বোঝায়। চীৎকারের সাথে অশ্লীল মুখভঙ্গি ও কথার গালিগালাজ কিন্তু তার অতিমাত্রায় রাগের প্রক্ষেপন মাত্র। লোকটিকে আমরা না বুঝে খুব খারাপ বলি, অথচ চিন্তা করি না যে সে রেগে গেছে,  রাগ প্রশমনের জন্যে এ্মন আচরণের জরুরি প্রয়োজন ছিলো। রাগ ঠিক ছিলো কি ভুল ছিলো সেটি পরের বিচার-বিশ্লেষণের কথা। অশ্লীল বাক্যবান ও অর্থহীন চীৎকার তাকে সাহায্য করছে স্বাভাবিক হতে, যখন তাকে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি, হয়তো আরও রাগের দিকে উস্কে দিয়েছিলো।

'রাগ' মানবিক প্রবৃত্তির এক আশ্চর্য অবস্থা, কেননা এটি  প্রশমিত (নিষ্ক্রিয়) হতে (catharsis)  ধ্বংসাত্মক কিছুর প্রয়োজন হয়। এ জন্যে রেগে গেলে সে রাগ থামাতে ধ্বংসাত্মক কিছু করতে হয়, আসবাবপত্র ভাংচুর বা গালিগালাজের মতো একটা কিছু। কিন্তু কেনো ধ্বংসাত্মক কাজের মাধ্যমে রাগ প্রশমিত হয়, তা জানা প্রয়োজন। মানুষের জীবন সংগ্রামের সাথে এর কোনও যোগসূত্র আছে? কোনো না কোনোভাবে নিশ্চয় আছে। 

রাগ,  এটি আত্মরক্ষার কৌশল, যদিও শাস্তিদায়ক, আত্ম-নিপীড়নমূলক আচরণ। যখন আমরা  কাজের মাধ্যমে বা বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে কোনো অন্যায়কে থামাতে পারি না, অন্যের কাছ থেকে সাহায্যও  পাই না, নিজেরা যাতনা ভোগ করি, তখন অন্তিম রাগের মাধ্যমে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে চাই । বর্তমানে বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানে   Recalibration Theory (২০০৯খৃ.) নামককে তত্ত্ব জনপ্রিয় হয়েছে, যা বলছে ‘রাগ’ রাগী ব্যক্তির পক্ষে এক ধরণের দর কষাকষির (bargaining capacity) সুযোগ করে দেয় যেখানে ফলাফল তার অনুকূলে যায়। যা হোক, সভ্যতার  আদিম পর্বে এটি হয়তো অস্তিত্বের মৌলিক প্রয়োজনে মানুষের আত্ম্রক্ষার কৌশলরূপে একটি যৌথ আচরণ ছিলো। ধীরে ধীরে ব্যক্তি সত্তার বিকাশে এটি পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে মানব সমাজে বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। এক সময় বুদ্ধিবিকাশের পথ ধরে টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রবৃত্তিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে মানুষ 'রাগ' নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন শুরু করে। 


(৩) আবার ফিরে যাই সে প্রশ্নে, কেনো ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে রাগ এতো সহজে প্রশমিত হয়?                     
এটি কোনো গবেষণা নয়, একান্তই আমার নিজস্ব অনুধ্যান, মানুষ 'রাগ' নামক আত্ম্রক্ষার কৌশলকে  অন্যের অপরাধের  বিরুদ্ধে কার্যকর আচরণ হিসেবে ব্যবহার করতে শিখেছে, এবং যখন মানুষ বুঝতে শিখেছে 'রাগ' নিজেই একটি অপরাধমূলক  আচরণ তখন সে অপরাধী ব্যক্তিকে  রাগ প্রকাশের মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে শাস্তি না দিয়ে বা নিজের যাতনাকে  লাঘব করতে  বিকল্প পথে ধ্বংসাত্মক কাজের মাধ্যমে মীমাংসা করতে চেষ্টা করে। এটি আর কিছু নয় অপরাধী ব্যক্তির পাওনা শাস্তিকে বিকল্প পথে বাস্তবায়ন করা, আর নিজের কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া।

বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক উন্নতির সাথে মানুষ এখন জেনে গেছে রাগ প্রশমনের জন্যে ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়ার চেয়েও ভালো কিছুর খোঁজ প্রয়োজন। মানুষের অনুশোচনাবোধ এখন অনেক গভীর হয়েছে। সংঘটিত রাগের পরমূহূর্তের অপরাধবোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে এখন সে কোন উপায় অবলম্বন করবে?  নাকি চিরকাল বিভিন্ন ঘুরো পথে প্রবৃত্তির দাস হয়েই থাকতে হবে? রাগ নিয়ন্ত্রণের অনেক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু মৌলিক সমস্যাটি রয়ে গেছে। ধ্যান, রাগের তাৎক্ষণিক কারণ বিশ্লেষণ, মনোযোগের পরিবর্তন, অথবা আবেগের হার্ড ব্রেক কষে রাগকে কঠোর হাতে দমন, এগুলি কৌশল হতে পারে, কিন্তু রাগের মতো মৌলিক, আদিম প্রবৃত্তিকে  নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, অপরাধীকে অপরাধী না ভেবে ভিক্টিম ভাবা, তাকে শাস্তি না দিয়ে সাহায্য করা, দৃষ্টিভঙ্গির এমন পরিবর্তন রাগের সীমা টেনে ধরার জন্যে সত্যি অসাধারণ উপায় হতে পারে।  আমাদের বহুদিনের লালিত সংস্কার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের প্রধান বাধা, কিন্তু  হৃদয়ের পবিত্র বিশ্বাস সে কাজকে সহজ করে দেয়। পবিত্র বিশ্বাস মানুষকে প্রজ্ঞার শিক্ষা দেয়, সঠিক পথ দেখায়।     

আল্লাহ যেমন মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন, প্রবৃত্তির দাস না হতে। এর অর্থ মানুষের সে নিয়ন্ত্রণশক্তি আছে।  

Comments

Popular posts from this blog

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

যদি এমন হতো? -আইনুল বারী