আমাদের কোনো নাগরিক সমাজ নেই- আইনুল বারী

আমাদের কোনো নাগরিক সমাজ নেই-
আইনুল বারী
----------

এ মুহূর্তে প্রকৃতপক্ষে আমাদের কোনো নাগরিক সমাজ নেই। নাগরিক সমাজ ধ্বংস হওয়ার কারণ ব্যক্তিক দুর্নীতির মধ্য দিয়ে আড়ালে আড়ালে বেড়ে ওঠা গোষ্ঠীগত স্বার্থবাদী চিন্তা-চেতনার এক প্রকান্ড দানবীয় অশুভে’ক শক্তির প্রবল হয়ে ওঠা। প্রতিদিন এ অশুভ’  রাষ্ট্রকে দুর্বল করেছে আর রাষ্ট্রের দুর্বলতায় নাগরিক সমাজে ফাটলের শেকড় গেড়েছে।  সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এ দেশে মার্ক্সীয় শ্রেণী সংগ্রাম নয়, মূলত স্বার্থবাদী অজস্র গোষ্ঠীই এখন অর্থনৈতিক লোভ সম্পর্কের গোষ্ঠীগত সংঘাতে লিপ্ত। সমাজে তাই নাগরিক সমাজ বলে কিছু নেই আজ। সবল গোষ্ঠী দুর্বল গোষ্ঠীর ওপর নিজের হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ সব গোষ্ঠীগত সংঘাতের মধ্য দিয়ে নাগরিক সমাজের সত্য, সুন্দর, শুভ-এর অপমৃত্যু ঘটে ।
 
২। আইন, মূল্যবোধ, শিক্ষা, অর্থনীতি, সাহিত্য সংস্কৃতি যখন আধুনিক সময়ের সাথে খাপ খায় না, আর দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান/সংগঠন বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিকল্পনা আর নীতির মাধ্যমে সে সবের পরিবর্তনের চেষ্টা করে না বা পারে না, তখন ব্যক্তিরা চেষ্টা করে নিজেদের অনুকুলে সিন্ডিকেট এর মতো স্বার্থবাদী গোষ্ঠী গড়ে তুলতে। এ পরাক্রম হয়ে ওঠা গোষ্ঠীগুলি ক্ষমতার পায়ভটগুলি দখলে নিতে চায়। নিজেদের অংশে প্রতিষ্ঠানের পলিসির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়। প্রয়োজনে সব চেয়ে নোংরা পরিস্থিতিতে আইনকে পাশ কাটিয়ে, নীতির বাইরে গিয়ে, এবং সর্বজনীন মানবতাকে বিসর্জন দিয়ে হলেও তারা প্রবল ভাবে টিকে থাকতে চায়। 

৩। অজস্র স্বার্থবাদী গোষ্ঠী আমাদের উন্নত জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য একটি এক ও অভিন্ন মনের সংঘবদ্ধ নাগরিক সমাজকে বেড়ে উঠতে দেয়নি। প্রজন্মের ভেতরেও এ দ্বিধা-বিভক্তির সংক্রামণ ঘটিয়ে চলেছে। তাই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম সমষ্টিগত নাগরিক অধিকারগুলি গোষ্ঠীগত অর্থনৈতিক লোভের মোহে বিলুপ্ত হয়েছে। নাগরিক অধিকার নিয়ে আজ কোনো সত্যিকার কন্ঠস্বর নেই আমাদের। গোষ্ঠীরাই নাগরিকের কথা বলে নিজেদের পারস্পেক্টিভে। তাই তা হয় নিষ্ফল, আবেদনহীন এক ছিঁচ কাঁদুনের মতো।  এই অবক্ষয় দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

৪। গোষ্ঠীর মধ্য দিয়ে লোভী শংকিত ব্যাক্তি তার মনোবল ফিরে পায়, নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পায়, দাবি পেশ করতে পারে, নিজের অবাধ্যতারও পরিত্রাণ পায়। গোষ্ঠী সত্তা থেকে সদস্যরা আইনকে না মানার, নীতির বাইরে গিয়ে সুবিধা খোঁজার, দাবি আদায়ে ধ্বংসাত্মক কাজেরও মৌন সম্মতি পায়। এ হিসেব এক সহজ অংকের মতো বলে সে অন্ধের মতো তা অনুসরণ করে চলে। 

৫। এভাবে প্রতিটি সংগঠন/সংস্থাগুলি  হয়ে উঠেছে চাপ প্রয়োগকারী এক একটা গোষ্ঠীর মতো। জনসেবাধর্মী সংস্থা, প্রশাসন, সাংবাদিক সমাজ, এফবিসিসিআই, গার্মেন্টস ব্যবাসায়ী, কর্পোরেট বিজনেস সিন্ডিকেট, টেলি কমিউনিকেশন সেক্টর, মাল্টি লেটারেল বিজনেস কোম্পানী, হকার সমিতি, ট্রাভেল এজেন্সি, রিহাব, আইনজীবী সমিতি, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন, ক্রীড়া সংগঠন, কওমি মাদ্রাসা ও ছাত্র সমাজ, চ্ছিন্নমূল বাস্তুহারা গোষ্ঠী, লেখক-বুদ্ধিজীবী শিক্ষক সংগঠন, প্রাইভেট সিকুইরিটি কোম্পানী, জুয়েলারি ব্যাবসায়ী গোষ্ঠী, দলিল লেখক, আয়ুর্বেদিক সমিতি ইত্যাদি ইত্যাদি-সবাই এক চরিত্রের। প্রান্তিক, দুর্বল যারা এখনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী হয়ে ওঠেনি বা উঠতে পারেনি বা এমনকি তেমন কিছু হয়ে উঠতে চায় না, তাদেরকে অন্যেরা মিলে কোনোভাবে লেবেলিং করে অপুষ্ট গোষ্ঠীতন্ত্রের দিকেই ঠেলে দেয় জোর করে, নাগরিকবোধ নিয়ে জনগণের সাথে মিশিতে দেয় না। ...  সে একটা গোষ্ঠীর বেশি কিছু নয়, তা তাকে মরিয়া হয়ে ভাবতে শেখায়। 

৬। সমাজে বহু বিভক্ত এ ধরণের গোষ্ঠীরা জাতি বা সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনের চেয়ে নিজেদের বিকাশকেই জরুরি মনে করে। বলিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলি 'স্টাটাস কু' বজায় রাখতে গবেষণা করে, বিনিয়োগ করে, এজেন্ট নিয়োগ করে। রাজনীতি, প্রশাসন, মিডিয়া, বিচারব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক লবি - সব ক্ষেত্রেই নিজেদের যোগাযোগ এন্টেনা স্থাপন করে। তাদের মিলিত প্রয়াসে দানবীয় অশুভের জন্ম হয়। অশুভ ব্যক্তিক চেতনার মধ্যে আফিমের মতো বিবশতার নেশা ধরিয়ে রাখে, ভুল সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে শাসনের নির্বাচিত শব্দ, প্রতীক, সংকেতকে। যুক্তির বদলে কমনসেন্সের নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। হুজুগ ও প্রচারণাকে প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিষয়কে বোঝার প্রধানতম বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি হিসেবে। বিশ্লেষক-বুদ্ধিজীবিরা সাধরণ সংবাদ পাঠকের পর্যায়ে নেমে আসে। 

৭। আমাদের নাগরিক সমাজ নেই বলেই দিনে দিনে সুস্থ নাগরিক জীবন যাপনের সংস্কৃতি বেড়ে ওঠে না, সুস্থ জীবন যাপনের সংস্কৃতির জন্য তেমন মায়াবী চিন্তার বিকাশ ঘটে না, তৈরি হয় না নির্ভুল পলিসি, আইন প্রয়োগ আর আইন মানা অসম্ভবের সমার্থক হয়ে ওঠে-সবকিছু সবকিছুকে নেগেট করতে চায়। সামষ্টিক হাহাকার ও বেদনা ব্যক্তিক চ্যানেল বেয়ে নীতিহীন সুবিধাবাদী কানাগলি পথে সামাজিক অন্ধকারে প্রশমিত হয়। হৃদয় নিষ্ঠুরতায় অ-মানবিক হয়ে ওঠে। গাড়ির গ্লাশ নামিয়ে পঙ্গু শিশু ভিক্ষুকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় কোনো মানবাধিকার নেত্রী, তার গাড়ী হয়তো 'সেভ দ্য চিল্ড্রেনের' মতো কোনো প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্কশপের দিকে ছুটে যায়। ডাস্টবিনের পাশে নেশারত শিশুর পাশ দিয়ে হেঁটে যায় আধুনিক বিপ্লবী কবি, কষ্টের কবিতা লিখার জন্য তার চোখের তারা অনুসরণ করে কোনো সুন্দরী নারী। প্রতি মুহূর্ত জঘন্যতম পরিস্থিতির আশংকার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। সংকীর্ণ স্বার্থবাদী গোষ্ঠী চেতনা আমাদের ভালোবাসার সবকিছু কেড়ে নেয়। 

আল্লাহ আমদের সবাইকে হেফাজত করুন।

(পুরোনো লেখা থেকে। )

Comments

Popular posts from this blog

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস। -আইনুল বারী