প্রবঞ্চনার ভূবনে মিথ্যার নানা স্তরঃ -আইনুল বারী

প্রবঞ্চনার ভূবনে মিথ্যার নানা স্তরঃ
-আইনুল বারী
৬/১২/২০১৭
-------------------------------------------------

প্রবঞ্চনার ভূবনে মিথ্যার নানা স্তরঃ------------------------------- (১) সমাজ যখন সরলতাকে হারায় তখন ব্যক্তি, দল ও প্রতিষ্ঠান সব কিছুরই সরলতা নষ্ট হয়। এই সরলতা হারানোর অন্তর্নিহিত কারণ যদি হয় সামাজিক নৈতিকতার অধঃপতন, তখন মানুষে মানুষে সরল বিশ্বাসের সম্পর্ক আর টিকে থাকে না। এটি সাধারণভাবে সর্বসাধারণে প্রভাব ফেলে, যৌথ কর্মকান্ডের যোগফল হিসেবে। এক পর্যায়ে পুরো সমাজটাই মনস্তাত্ত্বিকভাবে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত (paranoid) হয়ে পড়ে। গণসন্দেহপ্রবণতার সামাজিকীকরণের ফল হলো, সর্বাত্মক প্রবঞ্চনা, যা দাঁড়িয়ে থাকে মিথ্যার নানা স্তরে, বিশ্বাসের নড়বড়ে ভিত্তির উপর। মানে মিথ্যার নানা স্তর তৈরি হয়, সত্যও ক্রমে দূরে সরে যায় । মিথ্যা বা সত্যকে পরষ্পর থেকে সুস্পষ্ট ব্যবধানে, সরাসরি, একক চেহাড়ায়, নির্ভেজালরূপে ও সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। এক কথায় আমরা প্রবঞ্চনার ভূবনে ভাসতে থাকি,ডুবতে থাকি। (২) সমাজ প্রবঞ্চনাময় হয় বলেই মিথ্যার নানা স্তর তৈরি হয়। অর্থাৎ সত্য ও মিথ্যা সাজানো থাকে পিঁয়াজের খোসার মতোঃ সত্যের ক্ষেত্রে প্রতি ধাপে সত্য উম্মোচিত হয় অল্প অল্প করে, শেষ ধাপে সত্যের প্রকৃত রূপকে পরিপূর্ণতায় ধরা পড়ে, আর মিথ্যার ক্ষেত্রে পিঁয়াজের খোসাগুলি ছাড়াতে ছাড়াতে শেষ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায় না। মিথ্যা ছদ্মবেশ ধারণ করে আসে, প্রলুব্ধ করে টার্গেটকে, ধাপে ধাপে তাকে নিয়ে যায় 'কিছুই নাই' এর দিকে। এই হলো ধোঁকা বা প্রবঞ্চনা। (৩) ধরা যাক, একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী, তিনি একটি বক্তৃতা দিচ্ছেন শিশু শিক্ষার উপর। তিনি তার বক্তৃতায় কিছু সমালোচনা করলেন, কিছু প্রশংসা করলেন, তারপর একটা উপসংহার টানলেন। তার সমালোচনা ও প্রশংসা ছিলো কিছু বিষয় নিয়ে ও কারো কারো প্রসংগে। এখন প্রবঞ্চনাময় সমাজে, যেখানে বিশুদ্ধতার বড় অভাব, তাই ঐ শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবীকেও সন্দেহ করা প্রয়োজনীয়। তাকে আর চট করে বিশ্বাস করা যায় না। এজন্যে তার বক্তব্য গ্রহণ/বর্জনের ক্ষেত্রে যাচাই করে দেখতে হবে বক্তৃতার আয়োজকদের প্রোফাইল কেমন ও তাদের কর্মকান্ডের গভীর কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না। খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না, ইন্টারনেটের যুগে একটু নেট সার্চ দিলেই খোঁজ পাওয়া যায় কে কোথায় বেতনভুক্ত কর্মচারী, কার সাথে কার সম্পর্ক, কার কী মিশন ও ভিশন। বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী/সাথীদের ব্যাপারে প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানেই বের হয়ে আসতে পারে হয়তো বিরাট কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস! এমন হতে পারে কোনো স্বার্থেন্বেষী মহল তাকে কৌশলে ব্যবহার করছে, তিনি বুঝতেই পারছেন না। এই বক্তৃতাটিকে হয়তো বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে, কোনো চক্রের হাতে তুলে দেয়া হবে। (৪) হ্যাঁ, হয়তো ইতিহাস নিয়ে নিখাদ তত্ত্বালোচনাতেও ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য নিহিত আছে। বিভিন্ন সংস্থা প্রায় সব বিষয়েই দিকে দিকে ফ্রন্ট খুলে রেখেছে। এভাবে মানবাধিকার, নারীদের হিজাব বিতর্ক, গণতন্ত্র, জঙ্গিবাদ , ক্লাসিকাল সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন, যুদ্ধাস্ত্রের চুক্তি, নতুন হলে সিনেমা মুক্তি, হাইকোর্টে অভিনব রীট, পেশাজীবী কোনো গোষ্ঠীর বিদেশ ভ্রমণ, টক-শো, স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগীতা, পরীক্ষায় উস্কানিমূলক প্রশ্ন, মোবাইল ফোনে কোম্পানীর দেশপ্রেম নিয়ে বিজ্ঞাপন, সম্মেলন বা বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ,ইত্যাদির মাঝে লুকিয়ে আছে অন্য প্রকল্প, অন্য বিষয়। যা মিথ্যার প্রলোভনের মতো। (৫) প্রবঞ্চনার ভূবনে ভালো মানুষ ও ভালো ভালো কথা দিয়েই মিথ্যাকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটিই প্রবঞ্চনার (বুদ্ধিবৃত্তিক) শেষ ধাপ, মিথ্যার জটিলতম স্তর। এই স্তরের এজেন্ট হয়ে যারা কাজ করে তারা সবাই (বা সব সময়) হয়তো জানে না তারা কার জন্য, কীভাবে কাজ করছে। এই স্তরেই দেখা মিলবে ঐ সমস্ত ভালো মানুষদেরকে, যাদের বিশ্বাসভঙ্গ আমাদের মনোব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, আমরা হতাশ হয়ে বা চমকে উঠে বলি 'তাহলে আর কাকে আর বিশ্বাস করবো?' তাদের অনেক উদাহরণ আছে,সেগুলি নাম উল্লেখ করতে চাই না। তবে যে শুদ্ধ থাকে, শুদ্ধ থাকতে চায়, তার সত্যের শক্তির কাছে মিথ্যার রণকৌশল পরাজিত হয়, তার কাছে এসে সকল প্রবঞ্চনা ব্যর্থ হয়। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন। (পুরোনো লেখা।)

Comments

Popular posts from this blog

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস। -আইনুল বারী