পৃথিবীর অথবা সভ্যতার শেষ যুদ্ধঃ তথ্য ও ধারণার যুদ্ধ -আইনুল বারী

পৃথিবীর অথবা সভ্যতার শেষ যুদ্ধঃ তথ্য ও ধারণার যুদ্ধ
-আইনুল বারী
---------------------------------------------------------------------------
(১) তথ্য ও ধারণাকে আলাদাভাবে না লিখলেও চলতো, কেননা তথ্য ধারণার অন্তুর্ভুক্ত, তথ্য দিয়েই ধারণা শক্তিশালী হয়। সভ্যতার সূচনা থেকে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির পথে যখন থেকে যাপিত জীবনে চিন্তার মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে তখন থেকে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে ও গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে মতামত ও মতাদর্শগত অঘোষিত যুদ্ধের সুচনা হয়েছে। তবে তাকে একেবারে যুদ্ধ বলা সমিচীন নয়, বলা উচিত দ্বন্দ্ব-সংঘাত। পরবর্তীতে বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ আরও বেশি স্বার্থপর ও বিচ্ছিন্ন হলে দল ও কৌশল রচনা করে নিজেদের ধারণা তথা মতাদর্শকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে/(hegemony) প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। যুগে-যুগে মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার একটি সংগ্রাম জোরালো হয়েছে, নানা কলা- কৌশলে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তারী ক্ষমতার জন্ম দিয়েছে। সেখান থেকেই বল প্রয়োগ, আধিপত্যবাদী যুদ্ধের, ও যুদ্ধশাস্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন যেমন একটু একটু করে প্রস্ফুটিত হয়েছে যুগের মূল্যবোধ তথা নৈতিক মানদন্ডে, সামাজিক সচেতনতায়, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ব্যবহারের সাথে সাথে, তেমনি মানুষের ক্ষমতায়নের সাথে যুদ্ধের ও যুদ্ধাস্ত্রের ক্ষমতায়নেরও রূপ ও প্রকার বদলেছে।
(২) পৃথিবীতে যুদ্ধের ধরণ পাল্টে গেছে বহুবার, বহু যুগসন্ধিক্ষণে। কখনো পদাতিকরা হেরেছে বিরাট হস্তীবাহিনীর কাছে, হস্তিবাহিনীর সৈ্ন্যবহর পিছিয়ে গেছে দ্রুতগামী অশ্ববাহিনীর কাছে। শত্রু নিধনে তলোয়ারের চেয়ে কার্যকর হয়েছে দূর থেকে তীর-ধনুকের লক্ষ্যভেদ।মোংগলদের বিশ্ব জয়ের মূল মন্ত্র ছিলো ওরা ঘোড়ায় অসম্ভব পারদর্শী ছিলো। দূরের অভিযানে বিরতিহীন পথ চলতো, কয়েক রাত ঘোড়ার পিঠেই শরীর বেঁধে ঘুমোতো, ঘোড়ার মাংস খেতো, ঘোড়ার চামড়ার উৎপাদ জিন থেকেই তারা সমরাস্ত্র হিসেবে ধনুকের অভূতপূর্ব উন্নতি করে। গতি ও তীক্ষণতার এই এগিয়ে থাকা, যার সাথে যুক্ত হয়েছিলো মোংগলদের বেঁচে থাকার অদম্য লড়াই থেকে জন্ম নেয়া সাহস, সেটিই যুদ্ধ অভিযানগুলিতে চেঙ্গিস খান, হালাকু খানদের বিজয় এনে দেয়। তারপর ব্যাপক বিধ্বংসী আগ্নেয়াস্ত্র, কামানের গোলার কাছে শোচনীয় পরাজয় মেনেছে তির-ধনুক-তলোয়ারের সঙ্গিন প্রতিরোধ। যুদ্ধে যোগ হয়েছে ভূ-রাজনীতি, তার নিত্য-নতুন কলা-কৌশল, আর কখনো যুদ্ধে পরাক্রম হয়েছে বিপুল নৌশক্তি, কখনো বিমান শক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমরাস্ত্রের বহরে যোগ হয়েছে একেবারে পৃথিবী ধ্বংসকারী, মানব জাতি নির্মূলকারী পারমানবিক বোমার স্তুপ।পারমানবিক বোমার স্তুপ নিয়ে আজ আমরা বসে আছি, মহা প্রলয়কে হাতে নিয়ে।
(৩) কিন্তু মানুষের যুক্তিবাদী মন, মানবিক সত্তা, সাধারণ মানুষের সচেতনতায় অর্জিত নাগরিক অধিকার ও প্রতিরোধ ধীরে ধীরে প্রলয়ংকারী অস্ত্রের প্রতিযোগিতাকে মাঝে মাঝে থামিয়েছে, পারমানবিক যুদ্ধ বেধে যাওয়াকে বোকামি হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে, যুদ্ধংবাজি মনস্তত্ত্বেকে মানসিক বিকার বলে উপহাস ও তিরষ্কার করেছ; কিন্তু যুদ্ধ এরপরও থেমে থাকে নি। যুদ্ধ নানা মাত্রায় ঘোষিত -অঘোষিত চলছে। কখনো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ, ভূ-রাজনৈতিক-কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে, কখনো সরাসরি ছোট ছোট যুদ্ধের মাধ্যমে স্থানীয় আগ্রাসন। এর পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লব ও ইন্টারনেটের যুগে সাইবার আক্রমণ, হ্যাকিং তথ্য ফাঁস জনপ্রয়তা লাভ করছে। তথ্য ও ধারণার যুদ্ধ ও গোয়েন্দাগিরি আজ বহুগুণে ব্যাপকতা লাভ করেছে। বোধ করি স্নায়ু যুদ্ধ থেকে ধারণার যুদ্ধ নিজ শক্তি মত্তার প্রকৃত পরিচয় পেয়েছে। আর আজ ধারণার যুদ্ধই (war of information and war of ideas) প্রধান যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, অস্ত্রের যুদ্ধ ক্রমেই অসম্ভব ও নগণ্য হয়ে পড়ছে।
(৪) ধারণার যুদ্ধ নান দিকে বিভিন্ন ফ্রন্ট খুলে রেখেছে, যদিও এ যুদ্ধ অঘোষিত থাকে, তবু প্রবাহমান। এ যুগের অস্ত্র বুলেটের ও বোমার নির্ভুল নিশানা নয়, দুনিয়া জুড়ে সত্যকে ঢাকার মিথ্যা প্রচারণাকে বিশাল স্থাপনাকে ধ্বংস স্তুপে পরিণত করতে পারে একটি মাত্র নির্ভুল তথ্যের প্রবাহ। সত্য ও নিষ্পাপকে কুলষিত করার চক্রান্তের বিশ্বময় নেটওয়ার্ক একেবারে অকার্যকর করে দিতে পারে যুক্তির বোমা অথবা মজবুত গুটি কয়েক ধারণার সরল উচ্চারণ। এ যুগে যুদ্ধে জয়ী হতে হলে চাই তথ্য ও ধারণার যুদ্ধে জয়ী হওয়া। আমরা মানব জাতি সভ্যতার এমন এক যুগে পদার্পণ করেছি, এখন মিথ্যা গুজব ও পরিকল্পিত গোয়েবলসিয় প্রচারণার(Goebbels propaganda) ভোঁতা অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। আর তাই কতোগুলি পরাশক্তি সাথে নিয়েও মায়ানমার রোহিংগা ইস্যুতে নৈতিক পরাজয় বরণ করেছে বাংলাদেশের কাছে, ইসরাইল হেরেছে প্যালেস্টাইনের কাছে। একটি রাষ্ট্রের নৈতিক জয়ও যুদ্ধ জয়ের মতোই।
(৫) এ যুগে যুদ্ধে প্রাণঘাতি ও স্থাপনা বিধ্বংসী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে জয়ী হওয়া প্রায় অসম্ভব। অস্ত্র শুধু ভয় দেখায়, কিন্তু জয়ী করতে পারে না। অস্ত্রের দীর্ঘ নিয়মিত যুদ্ধ অর্থনৈতিকভাবে দেশকে ভারাক্রান্ত বা পঙ্গু করে দিতে পারে, কিন্তু ধারণার অস্ত্র বিজয় এনে দেয় খুব সহজে। ধারণার যুদ্ধে কোনো মতাদর্শ অথবা রাষ্ট্রশক্তি জয়ী হতে পারে কেবল সঠিক তথ্যের উপস্থাপনা ও শক্তিশালী ধারণার উচ্চারণে। কেননা মিথ্যার বিরুদ্ধে আমরা সত্যকেই স্বীকৃতি দিতে বা্ধ্য হই। সত্যকে প্রতিষ্ঠায় সঠিক তথ্যের মজুত আর সুতীক্ষ্ণ ধারণার শানিত আঘাতের মধ্যে ধারণাতীত ধ্বংস ও নির্মাণের ক্ষমতা আছে। অন্যায়ের ধ্বংস আর ন্যায় প্রতিষ্ঠার নির্মাণ শক্তি।

(৬) পৃথিবীর জনবহুল দরিদ্রপীড়িত দেশগুলি বিশ্ব সমাজে সামরিক পরাশক্তির প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকলেও মানবিক ও নৈতিক শক্তিতে নিজেদের এগিয়ে নিতে পারে। নৈতিক-প্রভাবশালী রাষ্ট্র /নৈতিক-পরাশক্তি হওয়াও কিন্তু কম কথা নয়, বরং অনেক বড় কথা। কেননা ধারণার যুদ্ধে এমন রাষ্ট্রই ক্ষমতাবান। যদি আমরা ধারণার যুদ্ধে টিকে থাকতে চাই, তবে আমাদের চেতনাকে জাগাতে হবে নৈতিক আন্দোলনে, মিথ্যার কূট-কৌশলে না গিয়ে সততার সাথে সঠিক তথ্যের ও সত্য ধারনার বিপ্লব ঘটাতে হবে সামাজিক মনে। সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বাসের সাথে অনুভব করি, মানুষের ক্ষমতায়নের প্রকৃত ও শেষ যুদ্ধ হলো পরষ্পর বিরোধী স্বার্থে নিয়োজিত ধারণার যুদ্ধ। যার জয়-পরাজয় সত্য সাহসী উচ্চারণের, শব্দের-কথার, তথ্যের-ধারণা, উন্নত নৈতিকতার শক্তিতে।

Comments

Popular posts from this blog

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস। -আইনুল বারী