বাংলায় ইসলামের আগমন ও সামজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক রূপান্তরের নীরব বিপ্লবঃ বিকল্প ইতিহাস পাঠ -২

বাংলায় ইসলামের আগমন ও সামজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক রূপান্তরের নীরব বিপ্লবঃ
বিকল্প ইতিহাস পাঠ -২
-আইনুল বারী
----------------------

বাংলা ভাষার আত্মপরিচয়ের সন্ধানেঃ
আদিকালে এ অঞ্চলের বিভিন্ন জনপদের সর্বসাধারণের কথ্যভাষা ছিল নানা ধরণের প্রাকৃত ভাষা। অনু. খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভাষাসমূহের প্রচলন ছিলো। ভাষাবিদদের মতে সমস্ত প্রাকৃত ভাষারই শেষ স্তরটি হল অপভ্রংশ। মোটামুটি হিসেবে খৃষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের শেষ প্রান্তে এসে মধ্য ভারতীয় আর্য প্রাকৃত ভাষাগুলির অপভ্রংশ (অর্থাৎ যা খুব বিকৃত হয়ে গেছে এমন) অবস্থা থেকে স্বতন্ত্র পরিচয়ে আধুনিক রূপে বেরিয়ে আসতে শুরু করে ভারতের নব্য ইন্দো-আর্য আঞ্চলিক ভাষাগুলি, বাংলা-অসামিয়া-ওড়িয়া ভাষা তার অন্যতম। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো গবেষকদের মত হলো, পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকেই বাংলা,আসামি ও উড়িয়া,মৈথিলি ইত্যাদি ভাষা উদ্ভূত হয়েছে। পূর্বী অপভ্রংশ থেকে গৌড়ীয় ধারার বাংলা-অসামিয়া-ওড়িয়া এই তিনটি ভাষার মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক বিদ্যমান। অনু. ৯০০- ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলা ভাষার যে বিকাশ ঘটে, একেই প্রাচীন বাংলা নাম দিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছেন ঐতিহাসকরা। এ কালপর্বে বাংলা ভাষার নিদর্শনগুলির মধ্যে আছে চর্যাপদ, ভক্তিমূলক গান, আমি, তুমি, সর্বনামের আবির্ভাব, ক্রিয়াবিভক্তি -ইলা, -ইবা, ইত্যাদি।
চর্যাপদকে (অনু. ১০০০-১৩০০ খৃষ্টাব্দ) আমরা বাংলা লিখিত ভাষার আদি রূপ হিসেবে মনে করা হয়। বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্যগণ বাংলা ভাষায় কিছু লিখেছিলেন কিনা তা জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক হর প্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল গমন করেন, সেখানে নেপাল রাজ দরবারের রয়্যাল লাইব্রেরী থেকে (১৯০৭ খৃষ্টাব্দ) প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথির সাথে পেয়ে যান ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের’ পুঁথিটি, যেটি বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন রচিত বলে প্রতীয়মান হয়। চর্যাপদ রচনার কাল পর্ব নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে বটে, তবে তা যে বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া লেখকগণই এর রচিয়তা, এটি অনুমান করা কঠিন নয়।
তবে চর্যাপদের ভাষার একক দাবীদার শুধু বাংলাই নয়, অসামিয়া, ওড়িয়া, মৈথিলি ভাষাও এর সাথে সম্পৃক্ততার দাবিদার। চর্যাপদে বাংলা-অসামিয়া-উড়িয়া তিনটি ভাষাকে এক ভাষারই ত্রয়ী রূপে বিবেচনা করা যায়। অর্থাৎ আমরা দেখবো যে এই তিন ভাষার কোনো একটি আরেকটির দিকে ঝুঁকে পড়লেও, তিন ভাষার কেউই তখনো স্বতন্ত্র পরিচয়ে আবির্ভুত হয় নি। চর্যাপদের নিদর্শনকে বাংলা, অসামিয়া, উড়িয়া তিনটি ভাষারই আদি রূপ বা যৌথ স্মৃতি রূপে অভিহিত করা যেতে পারে। কাজেই চর্যাপদের ভাষা শুধু বাংলা ভাষা ছিলো না। চর্যাগীতিতে ব্যবহৃত উপমা ও রূপকল্পগুলি যে অঞ্চলের মানুষদের সমাজ জীবন ও প্রাকৃতিক উপাদান থেকে সংগৃহীত হয়েছিলো তার সীমা কিন্তু বাংলাদেশের জনপদ গুলি ছাড়িয়ে আরও বিস্তৃত ছিলো, আসাম,বিহার,ঝাড়খন্ডের ভাষাভাষী অঞ্চল পর্যন্ত। চর্যাপদের কবি লুইপা, কাহ্নপারা ছিলেন উড়িষ্যার লোক, সেটিও মনে রাখা দরকার।
চর্যাপদের একটি কবিতায় এক দুঃখী কবি তাঁর সংসারের অভাবের ছবি এঁকেছেন এভাবে, ‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী। হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী। বেঙ্গ সংসার বডহিল জাঅ। দুহিল দুধ কি বেন্টে ষামায়।’ (পদ ৩৩) (অর্থ: টিলার ওপরে আমার ঘর, আমার কোনো প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে আমার ভাত নেই, আমি প্রতিদিন উপোস থাকি। বেঙের মতো প্রতিদিন আমার সংসার বেড়ে চলেছে, যে-দুধ দোহানো হয়েছে তা আবার ফিরে যাচ্ছে গাভীর বাঁটে।) আহা!
আসলে একটি বড় ভাষার মধ্যে কয়েকটি আঞ্চলিক/শাখা/উপ ভাষা সংমিশ্রিত অবস্থায় অভিন্ন ভাষা আকারে থাকতে পারে, যেখান থেকে যুগ সন্ধিক্ষণে শাখা/উপ ভাষা গুলি আঞ্চলিকতায় বা উপ-আঞ্চলিকতায় বিভক্ত হয়ে স্বতন্ত্র পরিচয়ে বেরিয়ে আসে। এই ঐতিহাসিক গুরুত্বপুর্ণ ঘটনাটি ঘটে বাস্তবতার কার্যকারণে, কতোগুলি প্রবল হয়ে উঠা সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক রূপান্তরের অনুঘটকের সঞ্চালনায়। ভাষা যতোক্ষণ না বড় ভাষা থেকে স্বতন্ত্র হয়ে বেরিয়ে আসছে ততোক্ষণ ভাষার আমিত্ব সম্ভাবনা আকারে ঘুমিয়ে থাকে। ভাষা স্বাধীনতা হয় পূর্ণ আত্ম পরিচয়ে, আত্মসচেতনতার যুগে। বাংলা ভাষারও তেমনি এক আত্মসচেতনতার কাল রয়েছে। বিনয়ের সাথে অনুমান করি, চর্যাপদ সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ নয়, বাংলা ভাষা আলাদা হয়েছে আরও পরে, মুসলিম শাসকদের শাসনামলে।
তিন ভাষা থেকে প্রথমে ওড়িয়া, তারপর অসামিয়া চৌদ্দ শতকের শেষের দিকে বেরিয়ে এসেছিলো বলে ধারণা করা হয়। অথবা এ সময়েই বাংলা ভাষা প্রথমে ওড়িয়া থেকে, তারপর অসামিয়া থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র পরিচয়ে আত্ম-প্রকাশ করে। কেনো চৌদ্দ শতকের শেষ ভাগে এসে তিনটি ভাষার পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া? এর উত্তর খুঁজতে হবে এই তিন ভাষাভাষী মানুষের অঞ্চলে কোন কোন বড় ঐতিহাসিক ঘটনা সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিলো। সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলিই ভাষায় অনুপ্রবেশ করেছিলো বিপুল শব্দ ভান্ডার নিয়ে, কথায় ও লেখায় ভাষার ব্যবহারে পরিবর্তনকে অনিবার্য করে তুলেছিলো, এক এক অঞ্চলে এক একভাবে তার পরিবর্তন নিজেদের ভাষাকে সাজিয়েছিলো নতুন বিন্যাসে।
স্বাধীন ভাষা পরিচয়ে বাংলা ভাষার আলাদা হয়ে যাওয়ার এই যুগ সন্ধিকালীন (১৩০০ থেকে ১৪০০ খৃষ্টাব্দ অনু.) পরিবর্তনের সব চেয়ে বড় কারণ বলে প্রতীয়মান হয় বাংলায় মুসলমান শাসকদের অনুপ্রবেশ। কেননা এ সময়টুকুতে আরবী, ফার্সী, তুর্কী অঞ্চলের প্রায় তিন হাজার বিদেশী শব্দ বাংলার প্রচলিত শব্দ-ভান্ডার যোগ হয়। ইসলামের আগমনের শুরু থেকে কিছু শব্দ যোগ হয়েছিলো বটে, কিন্তু মুসলমান শাসনামলে শব্দের এই খরস্রোত বাংলা ভাষাকে তার মূল প্রবাহ মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশ মূল ধারা থেকে পৃথক করে নতুন দিকের বাঁক এনে দেয় । জন্ম নেয় নতুন ভাষার স্রোত ধারা। ওড়িয়া ও অসামিয়া ভাষা নিয়ে যারা গবেষণা করছেন, তারাও এই সন্ধিক্ষণকে পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রায় নির্ভুলভাবে।
মুসলিম শাসনামলে এই বিপুলায়তনের আরবী -ফার্সি-তুর্কী-আফগানী শব্দ অনিবার্য ভাবে পরিবর্তনের Critical Pressure হিসেবে বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করেছিলো। রাজ কাজে, মুদ্রায়, সরকারী আদেশ-নির্দেশ জারিতে, জমিজমার সংক্রান্ত বিষয়াদি-দলিল-দস্তাবেজ, কাজী অফিসের বিচার শালিসের কাজে, সমর নীতিতে, অর্থনীতিতে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অর্থাৎ জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় সকল দিকেই শাসকের ভাষা শাসন করেছিলো। এটি অবধারিত ছিলো।রাজা ভাষা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় প্রজা গ্রহণ করেছে। একজন মানুষ জীবনভর সর্বোচ্চ কয়টি শব্দে কথা বলে ও লেখে? সে বেছে নেয় তার জীবন যাপনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় কিছু সংখ্যক শব্দ, এই শব্দগুলি নিয়েই তার ভাষা। চৌদ্দ শতকে বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার খুব বিশাল কিছু ছিলো বলা যাবে না, বরং লোকালয়ের মানুষের পরিমিত সরল জীবন যাপনের মতোই পরিমিত ছিলো, তাই নতুন হাজার হাজার শব্দের অনুপ্রবেশ ভাষার শরীরে অনেক বড় পরিবর্তন নিয়ে এলো
অথচ দূর্ভাগ্য, বাংলা ভাষার আত্মসচেতন হয়ে উঠার এই মাহেন্দ্র ক্ষণকেই অন্ধকার যুগ হিসেবে (১২০২-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ) কেউ কেউ চিহ্নিত করেছেন। তারা চর্যাগীতির পরে বাংলা ভাষার আর কোনো নমুনা খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ কি খুঁজেছিলেন ঠিকভাবে? কেনো তারা সীমানা নির্ধারণ করতে চান, অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল ১২০২ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজি নদীয়া আক্রমণের মধ্য দিয়ে? সম্ভবত ইতিহাস নিয়েও দূর্নীতি চলে, আমি একে অজ্ঞতা বলবো না। মনস্তত্ত্বের চাপে, আত্মগত সংক্রামণ থেকে এক ইতিহাস থেকে বিভিন্ন ইতিহাস রচিত হয়, তাই আধুনিক সচেতনতার যুগে ইতিহাসের বিকল্প পাঠের প্রয়োজন। অজ্ঞ আমিও, তবু আমার এমন স্পর্ধার জন্যে ক্ষমা প্রার্থী। প্রত্যাশা করি একদিন এই অস্বীকৃতির মাঝে আবদ্ধ অন্ধকার যুগকে সোনালি যুগ বলা হবে।
(অসমাপ্ত)

Comments

Popular posts from this blog

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস। -আইনুল বারী