বাংলায় ইসলামের আগমন ও সামজিক-সাংস্কৃতিক রূপান্তরের নীরব বিপ্লবঃ বিকল্প ইতিহাস পাঠ -১

বাংলায় ইসলামের আগমন ও সামজিক-সাংস্কৃতিক রূপান্তরের নীরব বিপ্লবঃ বিকল্প ইতিহাস পাঠ-১
-আইনুল বারী
-- ------------ -------------
(১) বাংলায় ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটেছিলো তিনটি চ্যানেলে।
প্রথমতঃ আরব অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সাথে এ অঞ্চলের লোকালয়ের বাণিজ্যিক যোহাযোগের চ্যানেলে।আরব ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ দিন যাবৎ এ অঞ্চলের মানুষের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করে রেখেছিলো, তাদের মাধ্যমে আরবীয় সংস্কৃতির কিছু ছটা আর সেমিটিক ভাষার কিছু শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে, নবম-দশম-এগারো শতকের কাল পর্বে এসে অর্থাৎ প্রায় প্রথম যুগের ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটে অল্পবিস্তর।
দ্বিতীয়তঃ বারো শতকের পর থেকে ক্রমাগত এ দেশে সুফী-সাধক-পীর-ফকির ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের আবির্ভাব হয়। ভারতবর্ষ ও বাংলায় সুফীসহ বিভিন্ন ঘরণার ধর্ম প্রচারকদের স্রোতের মতো আগমনের একটি বড় ঐতিহাসিক কারণ ছিলো, দূর্ধষ মোংগল নেতা হালাকু খানের আক্রমণে বাগদাদের পতন ও ব্যাপক হত্যা্কান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ। হালাকু খানের এই আক্রমণ বলা চলে সেদিন একটি সভ্যতারই পতন ঘটিয়েছিলো । জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন চর্চার কেন্দ্রস্থল তথা রাজধানী ছিলো বাগদাদ, যুক্তিবাদী মুতাযিলা গোষ্ঠী ও তারপর মরমীবাদী সুফীদের প্রভাব আলোড়ন সৃষ্টি করে মুসলমানদের মনন ও দার্শনিক চিন্তাজগতে। মোংগল আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞের (১২৫৮ খৃষ্টাব্দ, প্রায় সকল ধরণের নৃশংসতা চলে এবং লক্ষাধিক নাগরিককে হত্যা করা হয় মর্মে ধারণা করা হয়। বাগদাদ প্রায় জনশূন্য ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়) । এই ঘটনার ফলে বাগদাদ থেকে সাধারণ মুসলমান থেকে শুরু করে বহু শায়খ, মাশায়েখ,পীর, সুফী দার্শনিক, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিক ও মানবতাবাদী চিন্তানায়কেরা দেশান্তরী হন। তখন তাদের শরনার্থী আশ্রয় শিবির হিসেবে সবচেয়ে নিরাপদ ভূমি ছিলো মুসলিম শাসকদের দ্বারা শাসিত ভারত বর্ষ ও বাংলাদেশের জনপদগুলি। বাংলা অঞ্চলে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী ( ১২০৩ খৃষ্টাব্দে বিহার আক্রমণ করেন, ১২০৪-তে নদীয়া ও ১২০০৫ এর দিকে গৌড় দখল করেন) অতর্কিতে রাজা লক্ষণ সেনের রাজপ্রাসদ দখল করে সেন রাজত্বের পতন ঘটিয়ে শাসন ক্ষমতা দখল করেন। তার সময় থেকে বাংলা অঞ্চল মুসলাম শাসকদের অধীন হয়ে পড়ে, আর বাগদাদ থেকে শরনার্থীদের জন্যে এ অঞ্চল হয়ে উঠে অবারিত আশ্রয়স্থল। মুসলমানদের এই আগমনই ছিলো ভারতবর্ষে এবং বাংলা ভু-খন্ডের বিভিন্ন জনপদে ইসলাম ধর্ম প্রচারের মূল শক্তি। সুফি-সাধক-অলি-আউলিয়া-শায়খ-ফকির-পীড় যে নামেই ডাকি না কেনো তারাই ছিলেন বাংলায় প্রথম যুগের প্রকৃত ইসলাম ধর্ম প্রচারক। তাদের তালিকা বিরাট, সেখান থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য নাম হলোঃ- সিলেট অঞ্চলে শাহ জালাল, শাহ পরান, সৈয়দ নাসির উদ্দিন, শাতালং শাহ, চটগ্রাম অঞ্চলে বদর শাহ, গরীব উল্লাহ শাহ, মিসকিন শাহ, কালু শাহ, শাহ,বায়েজিদ বোস্তামী, আমানত শাহ, আকবর শা্হ, সৈয়দ আমিরুজ্জাম আমিরভান্ডারী, বগুড়ায় শাহ সুলতান ইব্রাহীম বলখী, বোরহান উদ্দিন, শাহ ফতেহ আলী অস্করী, আদম শাহ, ভাই পাগলা, রাজশাহী অঞ্চলে শাহ মখদুম রূপোস, সিরাজগঞ্জে খাজা ইউনুস আলী এনায়েতপুরী, মখদুম শাহ দৌলা ইয়েমেনি, সামস্উদ্দিন তাব্বরেজ, রংপুরে কারামত আলী শাহ , লালমনির হাটে শাহ সূফি ফজলুল করিম ওয়ার্ছী , খুলনা অঞ্চলে খান জাহান আলী, সাতক্ষীরায় খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ , ঢাকা অঞ্চলে শাহ আলী বাগদাদী, শারফুদ্দিন চিশতি, গোলাপ শাহ , জঙ্গি শাহ , সদর উদ্দিন আল চিশতি, শাহ সূফি দেওয়ান , ফরিদপুরে খাজা ফরিদপুরী, চন্দপাড়ায় আবুল ফজল চন্দপুরী, নেত্রকোনায় শাহ মোহাম্মদ সুলতান রুমি প্রমুখ।
তৃতীয়তঃ প্রধানত রাজনৈতিক কারণে ভারত বর্ষে ও বাংলায় মুসলিম শাসকরা এসে শাসন ক্ষমতা দখল করেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বাংলায় মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী ১২০০৩ থেকে ১২০০৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন জনপদে আক্রমণ চালিয়ে বাংলার শাসন ক্ষমতা নিজ দখলে নেন। তিনি ছিলেন একজন আফগান, তুর্কী খলজী সম্প্রদায়র্ভুক্ত সেনা । তার শাসন আমল থেকে ভারতবর্ষ ও বাংলায় মুসলমান শাস্কদের ধারাবাহিকভাবে শাসন ব্যাহত থাকে। মুসলিম শাসকদের শাসনকালে এ অঞ্চলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার ব্যাপকতা লাভ করে। শুধু ধর্ম প্রচারই নয়, রাজ কাজে প্রচুর পরিমাণে আরবী-ফার্সী, তুর্কী, আরব, মিশরীয় তথা আরব অঞ্চলের প্রায় ৩০০০ বিদেশী জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় শব্দ অন্তর্ভুত হয় বাংলা ভাষাভাষীদের শব্দ ভান্ডারে(vocabulary)। ভাষার সাথে ব্যাপক হারে জীবন সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের সংস্কৃত্যায়নও ঘটে নানা চ্যানেলে, যেমন মুদ্রা ব্যবস্থায়, খাজনা ব্যবস্থায়, সরকারী নির্দেশাবলীতে, দলিল-দস্তাবেজে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান-নৃত্য-গান ও সংস্কৃতি চর্চায়, কবিতা-সাহিত্য-জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন চর্চায়, নানা দিক দিয়ে বিপুলায়তনে সাংস্কৃত্যায়ন ঘটে।
(২) বাগদাদ,পারস্য, মধ্য এশিয়ার আরব অঞ্চলগুলি থেকে সুফী ঘরণার পীর-ফকির-দরবেশ-মাইজভাণ্ডারীরা এ দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত জনপদে এসে আস্তানা স্থাপন করেন। তারা বানিজ্যিক বা রাজনৈতিক কোনো স্বার্থ উদ্ধারে লিপ্ত ছিলেন না, তারা ইসলাম প্রচারের কাজেই আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তখনও বাংলাদেশ আধুনিক ঐক্যবদ্ধ বাংলা ভূ-খন্ড গড়ে উঠেনি, এ অঞ্চল রাজাদের শাসনের অধীনে কতোগুলি আলাদা আলদা জনপদে বিভিন্ন ছিলো। এমনকি বাঙ্গালী সংস্কৃতির যে রূপ আমরা আজ পেয়েছি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সমন্বয়, সহঅবস্থান, মানবতাবাদ, সহজ মানুষের দর্শন, বাউল চিন্তাধারা- তাও তখন পরিণতি লাভ করেনি। বাংলা ভাষাও স্বাধীন ভাষা হিসেবে তার স্বতন্ত্র রূপ লাভ করে নি। বা ঙ্গালী জাতির আত্মপরিচয়ের যে আত্ম-সচেতনতার যুগ সন্ধিক্ষণ, তখনো আসে নি। এ সব ধারবাহিকভাবে এসেছে এ অঞ্চলে ইসলামের আবির্ভাবের পরেই, ইসলামের পরশ পাথরের ছোঁয়ায় ও মুসলমান শাসকদের রাজ শাসনের প্রভাবে। ইসলামের পরশ পাথর নিয়ে এসেছিলেন আরব ভূমি থেকে এই সুফী-সাধক-পীর-ফকির-দরবেশেরা ।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত ব-দ্বীপের অনিশ্চিত কৃষিভিত্তিক দরিদ্র বঞ্চিত সহজিয়া মানুষের জনগোষ্ঠীর জীবনে তখন শাসকের আসনে আসীন ছিলো হিন্দু ধর্মের বর্ণবা্দী সমাজ ব্যবস্থা, ব্রাক্ষণ্যবাদের অভাবনীয় রাজত্ব। হিন্দু সমাজে সেদিন হিন্দু নিচু জাতের লোকেরা ছিলো ব্রাক্ষণ সমাজের কাছে অস্পর্শ্য, তাদের পূজা-আর্চনা করার অধিকার যেমন ছিলো না, তেমনি নিজ ভাষায় রামায়ন-মহা ভারত পড়ার অধিকারটুকুও ছিলো না, সতী দাহ প্রথার মতো নানা কু-সংস্কারের নিমজ্জিত ছিলো তখনকার হিন্দু সমাজ। অন্য দিকে বৌদ্ধ সমাজও ছিলো দ্বিধা-বিভক্ত, পলায়পর, সেন রাজাদের শাসন ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে পাল যুগের অবসান ঘটে, সেই সাথে বাংলায় বৌদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নির্মিত একটি সভ্যতারও বিপর্যয় ঘটে, শিক্ষার পীঠস্থান বৌদ্ধ বিহারগুলি হতে থাকে পরিত্যাক্ত, বাংলাদেশে বৌদ্ধেরা পরিণত হতে থাকে নিপীড়িত, পলায়নপর এক জন গোষ্ঠীতে। অন্যদিকে, আদিবাসী সমাজের অবস্থাও কখনো খুব ভালো ছিলো না, তারা বাংলার মূল ভূ-খন্ড থেকে বিদেশীদের আক্রমণ ও দখলদারির কারণে ক্রমাগত হচ্ছিলো কোণঠাসা । এ রকম এক ঐতিহাসিক পটভূমিতে ইসলামের আগমন ঘটে বঙ্গভূমিতে ।
এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে ফকির-দরবেশরা কোনো ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অভিলাষ পূরণের জন্যে রাজ ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন নি, মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করেন নি। বরং তারা গিয়েছিলেন দরিদ্র পীড়িত সহজ সাধারণ মানুষগুলির কাছে, বিপদে-আপদে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, শিখিয়েছিলেন মানবতা, ভালোবাসা, ভাতৃত্ববোধ। তারা নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে দেখিয়েছেন ইসলাম ধর্মে কোনো জাত-পাত ভেদ নেই, সকলেই সমান, এ শুধু কথার কথা নয়, বরং বাস্তবতাও। তারা বনে-বাদরে প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বাসযোগ্য করেছিলেন, সেখানে আস্তনা তৈরি করেছিলেন, আবাসহীন অসহায় মানুষদেরকে সেখানে থাকতে দিয়েছিলেন স্নেহ-ভালোবাসায়। তাদের কাছে ধর্ম প্রচারের জন্য হাদিসের পাহাড়সম স্তুপ ছিলো না, বাহাস-মজলিস ছিলো না, খেলাফত প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক ইসলাম ছিলো না, জংগীবাদী জিহাদী সন্ত্রাস ছিলো না। ছিলো মানবতাবাদ, ঈশ্বরপ্রেম, ভাতৃত্ববোধের অনুপ্রেরণাদায়ক শক্তি, ছিলো এমন শিক্ষার কুর’আনের কিছু বাণী, আর তার জন্য উদ্যোগ-কাজ। এর দ্বারাই ইসলামের আলো তারা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সহজ মানুষগুলির কাছে।
-অসমাপ্ত
(লেখাটি শুধু একাডেমিক বিবেচনার জন্য অনুরোধ করছি। কয়েকটি পর্বে লেখাটি সমাপ্ত করার আশা রাখি।)

Comments

Popular posts from this blog

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস। -আইনুল বারী