যেখানে প্রায় সবাই ব্যস্ত অমানুষ হওয়ার নাগরিক (কু)শিক্ষা কার্যক্রমেঃ -আইনুল বারী
যেখানে প্রায় সবাই ব্যস্ত অমানুষ হওয়ার নাগরিক
(কু)শিক্ষা কার্যক্রমে
-আইনুল বারী
৩/১২/২০১৭
----------------------------------------------
(লেখাটি একাডেমিক বিবেচনার অনুরোধ করছি।)
মানুষকে নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার
ক্ষেত্রে ও নাগরিক সত্তার সাথে একটি সুনির্দিষ্ট
নৈতিক জীবনবোধ জুড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাধর হলো নাগরিক
শিক্ষা।
নাগরিক শিক্ষায় কোনো ডিগ্রী অর্জন নেই, পাস-ফেইল
নেই, এই শিক্ষা প্রো-গণতান্ত্রিক ও সবাই প্রায়
সমান তালে অর্জন করতে পারে। তাই নাগরিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ও
কর্মদক্ষতা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের চেয়ে
অনেক গুণ বেশি । নাগরিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরা প্রতি মূহূর্ত অর্জিত শিক্ষাকে
কাজে লাগায়, অবৈতনিক উপায়ে। তাদের কর্ম জাতিকে কর্মফল
অনুসারে নির্দিষ্ট দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু নাগরিক শিক্ষা কেমন, তার উপর
নির্ভর করে জাতির ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নাগরিক শিক্ষার
সঞ্চালন ঘটতে থাকে বাধাহীনভাবে। আমরা যদি নিকৃষ্ট মানুষ হওয়ার শিক্ষাকেই নাগরিক
শিক্ষার পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করি তাহলে আমরা সেদিকেই অধপতিত হবো, আমরা ও
আমাদের সন্তানেরা হবো নিতান্তই দূর্ভাগা। তবে পাঠক্রমে শিক্ষাপাঠগুলিকে
অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি এককভাবে নির্দিষ্ট কারো বা কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকে
না, এটি নাগরিক সমাজের যৌথ আচরণেরই যোগফল।
কাজেই আইন লঙ্ঘন করা, শিশু ও প্রাণীর প্রতি নির্যাতনমূলক আচরণ, নির্মমতা-সন্ত্রাস, দূর্নীতিপরায়ণতা, ধোঁকাবাজি-এসবই
যদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে নাগরিক পাঠক্রমের মধ্যে থাকে ও অধিক মাত্রায় পঠিত-চর্চিত হয়, যা আমরা
প্রাত্যহিক নাগরিক জীবন-যাপনের মাধ্যমে লাভ করি ও প্রয়োগ করে থাকি, তাহলে
বুঝতে হবে আমাদের নাগরিক সমাজটিতে নিকৃষ্ট
মানুষ হওয়ার শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। আমরা হয়তো জানিও না, বুঝিও না, মানিও না, কিন্তু
নিকৃষ্ট নাগরিক, নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার একটি
ভারসাম্যপূর্ণ নাগরিক-সামাজিক পরিকল্পনার ভিতরে আমরা বাস করছি। এই পরিকল্পনায়
বিকল্প শিক্ষাকার্যক্রম হিসেবে
ভালো মানুষ, ভালো প্রজন্ম তৈরির সিলেবাস ও
কারিকুলাম আছে বটে তবে তার ছাত্র-শিক্ষকের সংখ্যা নিতান্তই কম বলে নাগরিক সমাজে
তার প্রভাবও অতি নগণ্য।
আ্রাম কীভাবে আমাদের নাগরিক
জীবন-যাপনে এমন কু-শিক্ষার কার্যক্রমকে
এগিয়ে নিচ্ছি তা নিচের পর্যবেক্ষণ(নাগরিক শিক্ষা পাঠ) থেকেই অনুমান করা
সহজ হবে আশা করি।
(২) এক.
- শিশু থেকেই নাগরিক
প্রজন্মের সুচনা। এই শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি
নাগরিক শিক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব এসে পড়ে স্কুল ও তার পরিবারের উপর। শহরের রাস্তা,
শপিং মল, শিশু পার্কের দোলনা কিংবা এন্ড্রোয়েড ফোন, যেখান থেকেই শিশু শিখুক, যাই
শিখুক, তা কিন্তু স্কুল ও পরিবারের অনুমোদন সাপেক্ষেই হয়ে থাকে। এখন আমাদের
শিশুদেরকে সু-নাগরিক বা কু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে স্কুল ও পরিবারগুলির
মধ্যস্থতায় কী কী শিখানো হচ্ছে সেদিকে একটু তাকাইঃ স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি স্বরূপ
শরীরের ওজনের সাথে সামঞ্জস্যহীন ওজনের গাদা-গাদা বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার সময় শিশু-সন্তানদেরকে
শারীরিক ও মানসিক কষ্ট অনুভব করানোর পাশাপাশি ক্ষতিকর যে কু-শিক্ষাটির আত্মস্থ
করতে শেখানো হয়, তা হলো, মা-বাবা-স্কুলের শিক্ষক কেউ তার প্রতি সহানুভূতিশীল নয়, বরং নির্মম,অত্যাচারী
শাসক। ক্লাশের শিক্ষকরা ঠিকমতো পড়া বোঝান না, বা বোঝাতে
পারেন না, সে জন্য
শিক্ষকের কোনো জবাবদাহিতা নেই, অথচ বাসায় ফিরে
মা রাগ করেন, কেনো তুমি পড়া বুঝে আসোনি, সিটি পরীক্ষায় ভালো ফল করোনি, এটি তাকে
চোখে আংগুল তুলে দেখিয়ে দেয়, বড়দের দায়িত্বহীনতা কাকে বলে। ক্রমাগত
বুঝতে না পারার সীমাবদ্ধতায় ভালোর তালিকা থেকে পিছিয়ে পড়া অভ্যাসে পরিণত হয়, লেখাপড়ায় মাথা ভালো না- এমন দুঃখজনক কথায়
কলংকিত হতে হয়, ফলে ব্যক্তিত্ব গঠনের গোড়াতেই শিশুর
আত্মবিশ্বাস নষ্ট হতে শুরু করে। নিজেকে বাঁচাতে সে মিথ্যা বলতে শুরু করে। রাত জেগে
পড়তে হয়, শিশুর পর্যাপ্ত ঘুম হয় না, শারীরিক
বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হয়, খেলাধুলো নেই, প্রাণ খুলে
গল্প-গুজব নেই, তাই ছোট বয়সেই হজমের সমস্যা ও পাকস্থলির
নানা জটিলতা, ভয় ও উদাসিনতার শুরু হয়। খুব দ্রুত পড়া মুখস্ত করা্য, আর একটার
পর একটা পরীক্ষার চাপে ভারাক্রান্ত শিশুর মনে অমূলক ভীতি সৃষ্টি হয়, এই ভীতি
থেকে নানা রকম সোশ্যাল ফোবিয়া, পার্সোনালিটি ডিসর্ডারের জন্ম হয়। অনেক
সময় কিশোর-কিশোরীরে মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে লুকিয়ে মোবাইলে নেট ঘাঁটে ও
সেখানেই ডুবে থাকে অন্য জগতে, যেখান থেকে তার বাস্তব পরিবেশ থেকে
বিচ্ছিন্নকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
দুই.
বাবাকে অসৎ উপায়ে উপার্জনে মনোযোগী হতে হয়, কেননা
সন্তানদের পড়াশোনার ব্যয় বেড়েছে অনেক। স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষকেরা স্কুলে পড়ানো
প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন ও নানা কৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছেন যেনো পরীক্ষা পত্রের
প্রশ্নের ও খাতা কাটার ও ফলাফলের জটিল ধাঁধায় বাচ্চা ও বাচ্চার মায়েরা বাধ্য হন
প্রাইভেট টিউটর ও কোচিংয়ে দিকে ছুটতে। মায়েরা স্কুলের বাইরে ফুটপাতে বসে থাকেন
সারাদিন ও নানা গল্প-গুজবে ব্যস্ত থাকেন, সেখানে পরচর্চাই
বেশি হয়। নোট ফটোকপি, ফাঁস প্রশ্নপত্রের খোঁজ, মিসকে
উপঢৌকন দিয়ে পটিয়ে রাখা , সামাজিক- সাংসারিক এর ওর দোষ ত্রুটি ধরা-
এরকম অনেক কিছুই রপ্ত করা হয় সেখান থেকে। ফলে ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংসা,প্রতারণা,দূর্নীতির
শিক্ষা লাভ হয় দিনের অনেকটা সময়। বাসায় টিভি চ্যানেল খুললেই সিরিয়ালগুলিতে
দেখা যায় একই পারিবারিক নোংরামির নাট্যরূপ, ভয়ঙ্কর
ছলা-কলার দীর্ঘ সিরিয়ালগুলি দেখে খারাপের
প্রতি প্রীতি জন্মায়, মনে সাহস জাগে, এসব ঠিক
আছে, হিংসা-প্রতারণা অপরাধমূলক কিছু নয়।
বাবারাও সুযোগ মতো স্ত্রীকে প্রতারণা করেন, অফিসে, ট্যুরে কাজের ফাঁকে, পরকিয়ায়
লিপ্ত হওয়ার পক্ষে যুক্তি হাজির করে দেয় কিছু প্রভাবশালী ধ্যান-ধারণা, বিজ্ঞাপন ও
ম্যাগাজিন। দূর্নীতি তাকে করতেই হয়, কেননা সবাই তাই করে বেঁচে আছে। মাছওয়ালা-তরকারিওয়ালা-সিএনজিওয়ালা-সেলুনে-ফাস্ট-ফু্ডের
দোকানে-জুতোর দোকানে-বইয়ের দোকানে-টেন্ডারবাজি ও কন্ট্রাক্টরিতে কোথায় ভালোভাবে
বেঁচে থাকার জন্যে দূর্নীতির নীতি নেই? ্কাজেই বাবা-মায়েরা জানেন, এখন সীমা
অতিক্রম না করলে দূর্নীতি নীতির মতোই স্বাভাবিক।
তিন.
রাস্তায় বেরুলে প্রায় সীমাহীন ট্রাফিক জ্যামের চাপে ধৈর্যচ্যুতি ও অবশেষে
অনুভূতিশূন্যতার জন্ম হয়, হর্ণ-হুইসেল-কালো ধোঁয়ায়, আর মানুষের একে অন্যের প্রতি নিষ্ঠুর
আচরণে, এমনকি ভিক্ষুকদের অন্যায় আচরণ ও
ধোঁকাবাজিতে হৃদয়বস্তুটি দিনে দিনে দানবিক রূপ নিতে শুরু করে। ট্রাফিক আইন কেউ
মানছে না, ফুটপাথের উপর মোটর বাইক উঠিয়ে দিচ্ছে কেউ, ফুট ওভার
ব্রীজ ব্যবহার না করে মানুষের ঢল যাচ্ছে হুরমুর করে চলন্ত
গাড়ির মাঝ খান দিয়ে, ব্যাকলাইট-ইন্ডিকেটরবিহীন লক্কর ঝক্কর
বাসগুলি কালো ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে বেপরোয়া গতিতে ও রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে
করতে এদিকে সেদিকে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ তাদেরকে থামিয়ে দিতে পারছে না।
দোকানীরা দোকান খুলে দোকানের ময়লা ঝাড় দিয়ে ডাস্টবিনে না ফেলে ফেলে দিচ্ছে রাস্তায়, কারো উচ্চবাচ্য করার তাগিদ
নেই। রাস্তার
অভুক্ত অসুস্থ কুকুরের দিকে বিন্দুমাত্র কেউ ভ্রুক্ষেপ করে না। ট্যানারির বর্জ্য
ফেলে নদী মেরে ফেলছে, দখলে নিচ্ছে ভূমি দস্যুরা, প্রতিরোধ করার মতো মজবুত শক্তি
নেই। মিছিল যাচ্ছে মানুষের দাবী-দাওয়া নিয়ে অথচ মানুষকেই কষ্ট দিতে দিতে, রাস্তা-ফুটপাত
দখল করে, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে, ভাংচুর করে
হিংস্রতা প্রদর্শনের মাধ্যমে। ফ্যাশন হাউজ, পার্লার ও তাদের মার্কেটগুলি সব দিবস অনুষ্ঠানগুলিকে ফ্যাশান বাণিজ্যের
অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে, ফলে দুঃখবোধের স্থানে ফূর্তির বোধ ও বিস্মৃতি ও অজ্ঞানতা সৃষ্টি
হচ্ছে। বাণিজ্যের বিজ্ঞাপন বলে দিচ্ছে কোনটা রুচিকর কোনটা অশ্লীল, কোনটা মূল্যবান
কোনটা ফালতু, কোনটা গুরুত্বপূর্ণ কোনটা অবহেলার যোগ্য, কোনটা ভালো কোনটা মন্দ।
গাছের সাথে বা বিদ্যুত পোলের সাথে, দোকান ঘরের খুটির সাথে বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলা
হচ্ছে শিশু-কিশোরকে, ধরা পড়া ছিচকে চোরকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলছে উল্লাসিত জনতা,
পরকীয়া প্রেমের বলি হচ্ছে স্বামী-সন্তান, জঙ্গি চাপাতির আঘাতে কুপিয়ে নিথর করে
দেয়া হচ্ছে নির্দোষ মানুষকে, ধর্মের কথা বলে হিংসা-বিদ্বেষের বিষ ঢেলে দেয়া হচ্ছে
ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের মনে। এ সবই আমরা শিখছি শহরের রাস্তা থেকে, তার অভিশপ্ত ভবনগুলি
থেকে, আবাসিক আস্তনাগুলি থেকে; আর তা থেকে
নির্মাণ করছি পালন করার জন্য নাগরিক অপসংস্কৃতি, নিকৃষ্ট নাগরিক বোধ, কু-নাগরিকতা,
অবমূল্যবোধ। শহরের, যে শহর আমরাই নির্মাণ করেছি ও করছি, নিজেদের সব চেয়ে খারাপ
ধরণের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে, সেই অশুভ অবারিত
জ্ঞান ও অনুশীলন থেকে, আমরা শিখছি কীভাবে অ-মানুষ হতে হয়। তাইতো শিখিছি আর আমাদের
সন্তানদেরকে শিখাচ্ছি সু-নাগরিক নয়, কু-নাগরিক হতে। ... এই ভয়ংকর শিক্ষা পাঠ আমাদের নাগরিক কু-শিক্ষা
কার্যক্রমেরই একটা ক্ষুদ্র অংশ, বলা চলে একটি অন্ধকার অধ্যায় মাত্র। এ জন্যে কেউ
একক ভাবে দায়ী নয়, আমরা সবাই এর সাথে জড়িত, না জেনে, না বুঝে,
না মেনেই হয়তো। তবে একদিন
নিশ্চয় এর বিপরীতটাই গলায় পাকানো রশির মতো সবার দিকে এগিয়ে আসবে। ...
(আপাতত এখানেই থামলাম, কেননা মনটা
বড় বেশি বিষিয়ে যাচ্ছে। )
Comments
Post a Comment