তথাকথিত প্রগতিশীল ধারার সিনেমায় 'ইসলাম' পরিবেশনা ও পুরষ্কারপ্রাপ্ত বাংলা সিনেমা 'টেলিভিশন' নিয়ে মন্তব্য -আইনুল বারী

তথাকথিত প্রগতিশীল ধারার সিনেমায় 'ইসলামপরিবেশনা ও পুরষ্কারপ্রাপ্ত 
বাংলা সিনেমা 'টেলিভিশননিয়ে সমালোচনা-মন্তব্য 
(পুরোনো লেখা থেকে)
-আইনুল বারী
--              --------            ---


সিনেমা-সাহিত্যে-চিত্রকর্মে পাশ্চাত্যের মূল্যায়নকে খুশি করে একটা ভালো আন্তর্জাতিক পুরষ্কার জুটিয়ে নিতে আধুনিক কালে, (কেউ বলেন  উত্তরাধুনিক)  তৃতীয় বিশ্বের সৃষ্টিশীল আঁতেল সমাজের জ্ঞানচর্চার জনপ্রিয় দুটি প্রধান বিষয় টিকে আছে, একটি হলো পাঁজরের হাড় বেরোনো দারিদ্র্যকে শিল্পীর আঁচরে নিখুঁতভাবে তুলে ধরা ও নানা বাঁকে বিপ্লবকে চিনিয়ে দেয়া; অন্যটি হলো বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদ কীভাবে সমাজকে পেছনোর দিকে টেনে ধরছে তার নানা রকম ন্যারেটিভ তৈরি করা । প্রথম  বিষয়টি উপস্থাপনের দিক দিয়ে ও বাজারজাতকরণের জন্য এখন অনেকটা জীর্ণ  হয়ে গেছে, কিনতু  হালের ফ্যাসানের মতো চাঞ্চল্যকরভাবে এখন চলছে ধর্মীয় মৌলবাদ।  ধর্মীয় মৌলবাদ বলতে যেটা আসলে বোঝানো হয় সেটা এককভাবে ইসলামকেই দায়ী করে, অর্থাৎ ধর্মীয় মৌলবাদ বলতেই ইসলামি মৌলবাদ, তার সাথে ভদ্রভাবে একটু সন্ত্রাসবাদের প্রলেপ জুড়ে দেয়া যাতে বার্তাটা পৌঁছে যায়, আর ধর্মান্ধতাকে ইসলামেরই অন্তর্নিহিত দোষ হিসেবে কিছু তথ্য ও সারগর্ভ ঘটনা দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করা, ইত্যাদি।      তথাকথিত প্রগতিশীল ধারার সিনেমায় 'ইসলামপরিবেশনা ও পুরষ্কারপ্রাপ্ত বাংলা সিনেমা 'টেলিভিশননিয়ে মন্তব্য

এবার ১৯ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর নির্মিত ছবি টেলিভিশনদক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরষ্কার পেলো । জেনে বেশ ভালোই লাগলো। মনস্থির করলাম সিনেমাটা দেখবো,ইন্টারনেটেই ইউটিউবে পাওয়া গেল। স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে জানতাম না সেটা কিসের কাহিনী,  স্ক্রিপ্ট রাইটার আনিসুল হক, পরে জানলাম সিনেমার গল্পের সঙ্গে অনেকটা মিল রয়েছে ইলমাজ এরডোগান (Yılmaz Erdoğan) পরিচালিত তুর্কি সিনেমা 'ভিজোনটেলের'(Vizontele) তুর্কি ভাষায় ভিজোনটেলে মানে টেলিভিশন। যা হোক যখন দেখতে শুরু করলাম দেখি গল্পটা কোনো না কোনোভাবে ঐ জনপ্রিয় ধারার,অর্থাৎ পাশ্চাত্যের মূল্যায়নকে খুশি করে একটা ভালো আন্তর্জাতিক পুরষ্কার জুটিয়ে নিতে  ইসলামের পশ্চাৎপদতা নিয়ে, কীভাবে মিডিয়ায় প্রচারিত  ইসলামের সুপার কম্পোজড জীবনবোধ ও শিক্ষাকে (যা বিকৃত ও ভুল)  তার সাথে যুক্ত করে দেখানো যায়। অথচ যাকে ইসলাম ভাবা হচ্ছে তাকে আদৌ ইসলামি শিক্ষা না বলে ইসলাম বিরোধী অশিক্ষা বলাই শ্রেয়!  এর আগে মাটির ময়নাও দেখেছি, একই  কাজ। আরো আগে দেখেছিলাম লাল সালু। লাল সালু সবদিক দিয়েই একটা বাজে প্রোডাক্ট মনে হয়েছে। সবচেয়ে দুর্বল হয়েছে স্ক্রিপ্টটা। 

উপন্যাসের সাহিত্য মূল্যকে অনেকখানি নষ্ট করে দিয়েছে। অভিনয় হয়েছে স্থুল মঞ্চ নাটকের মতো।  কিনতু মাটির ময়নার নানা ধরণের ত্রুটিবিচ্যুতি চোখে পড়লেও সেটির পেশাদারি ভিত্তি মজবুত মনে হয়েছে। শিশু শিল্পীদের অভিনয় ছিলো অসাধারণ, আর চমৎকার স্ক্রিপ্ট- অনেক সময় আমাকে মুগ্ধ করেছে।  ইসলামের গোঁড়ামি দেখাতে গিয়ে ইসলামকে সরাসরি গালি দেয়া হয় নি । বরং ইসলামকে ভালো খারাপ দুভাবেই ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করা হয়েছে। আমি বলবো কেন্দ্রিয় চরিত্রটাকে যা হোক একজন ভালো মানুষ হিসেবেই দেখানো হয়েছে। কিনতু সিনেমাটির নামের মোটিফ বা আরো গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিকেই ভালোভাবে বোঝা যায় নি। তার চেয়ে বরং হুমায়ুন আহমেদের শ্যামল ছায়াবা আগুনেরপরশমণিসিনেমায় যুদ্ধের পটভূমি অনেক সুস্পষ্ট হয়েছিলো। সে ভিন্ন প্রসংগ। ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। এ ছবি গুলি সব গুলোকে আমাদের দেশে বলা হয় প্রগতিশীল বা কিছুটা ভিন্নধারার ছবি।  দেশে বিদেশে এ গুলো প্রশংসিত হয়, নানা কারণে, একটা প্রধান কারণ পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামকে  ভয় পায়, সে জন্য ছবিগুলো  একেবারে অস্কার না পেলোও পশ্চিমা মূল্যায়নে আরো উৎসাহ সৃষ্টি করতে  ভালো কোনো আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পায়। মাটির ময়নার ব্যাপারে বলবো, ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলে এর উচ্চারণের মধ্যে আরো অনেক গভীরতা থাকতে পারতো, তাহলে ইসলামকে টার্গেট না করে টার্গেট করা হতো পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের ইসলামের বিকৃত অপব্যবহারকে। আর বুঝিয়ে দেয়া হতো তারা ইসলামের অপব্যাখ্যা করেছে, ঐ সামরিক জান্তারা, আর ইসলামকে রাজনীতিতে কীভাবে শয়তানের বন্ধুর মতো ব্যাবহার করেছে। কিনতু এটা বুঝিয়ে দেয়ার তাগিদ বা ইসলামের  জ্ঞানতো থাকতে হবে। তাই ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে, পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা যা করেছে তা যেনো ছিলো ইসলামেরই মূল কথা। ওটাই ইসলাম। ইসলাম অমনই, কিছুটা ভয়ংকর, কিছুটা ঐতিহাসিক, বাতিল। তবে পরিবেশনের নান্দনিকতা ছাড়া পাশ্চাত্যের বাজারে বিকোবে না বলে, সেখানে ইসলামকে সৌজন্যমূলকভাবে সরাসরি গালি দেয়া হয় না। নানা অভিপ্রায়মূলক তীর্যক চরিত্রের মাধ্যমে বলা হয়, অন্যগুলো খারাপ হলেও ঐ দাড়ি-টুপি পড়া মানুষটা মূলত ভালো লোকই ছিলো, ঐ ধর্ম গোঁড়া চেয়ারম্যান সাহে্বের চরিত্রটি একজন  সরল ধর্ম বিশ্বাসী মানুষেরই, তাঁর দোষ নেই, দোষ অন্য কোথাও। ব্যাক্তিকে প্রশংসা করে ইসলামকে মূল্যায়ন করার জায়গাটা উদাসিনভাবে হয়তো বা ইচ্ছাকৃত ধোঁয়াশা রাখা হয়। যেনো যাদের ইসলাম নিয়ে রাগ, ক্ষোভ, অভিযোগ, সন্দেহ আছে তাদের মধ্যে সেটা স্থির থাকে বা আরো জটিল আকার ধারণ করতে  পারে।  নিজেরা নিজস্ব ভয় নিয়ে ইসলাম থেকে  যতোটা পারে দূরে থাকুক।

টেলিভিশন ছবিটা সম্পর্কে আমার পূর্বোক্ত এসব ধারণাই মনে হচ্ছিলো, শেষ দৃশ্যটা না দেখা পর্যন্ত, না দেখলে তাই ভাবতাম। জানি না সিনেমটা কতোজন কতো ভাবে পাঠ করছেন, আমি কিনতু মনে করি যে উদ্দেশ্য যে ভাবনা থেকে এর স্ক্রিপ্টা লেখা হোক না কেনো আর মূল গল্পকার যিনিই হোন না কেনো এটা  ইসলামকে শেষ পর্যন্ত আঘাত করে নি। দেশ কাল বাস্তবতার কিছু খটকা থাকলেও ছবিটির পরিচালক বেশ ভালো করেছেন। 

শেষ দৃশ্যে মোড়ল লোকটির পবিত্র বিশ্বাসের যে আকুতি চিত্রায়িত করা হয়েছে, সেটাই ছবির সেরা অংশ। পুরষ্কার এ জন্যই। 


Comments

Popular posts from this blog

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস। -আইনুল বারী