মানব-উন্নয়নে আত্ম-সন্মানের বাজেট: বিকল্প ভাবনা -আইনুল বারী

মানব-উন্নয়নে  আত্ম-সন্মানের বাজেট: বিকল্প ভাবনা -আইনুল বারী
 -------------

একজন মানুষের কাছে হারানোর মতো একান্ত ব্যক্তিগত বড় সম্পদ কী আছে? উত্তর সহজ, 'আত্ম-সন্মান' বা 'আত্ম-মর্যাদা'। কিন্তু এটি সংকীর্ণ স্বার্থবাদ বা সেলিব্রেটি আত্ম-কেন্দ্রিকতা নয়, যা প্রচলিত পুঁজিবাদী জীবন-দর্শন সচারচর শেখায়। যখন মানুষের এই অমূল্য সম্পদ হারিয়ে যায়, বা কমতে থাকে কেবল তখনই সে নিঃস্ব হতে শুরু করে। এটিই মানুষের প্রকৃত দারিদ্র্য। আমরা যখন অর্থনীতির বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট পরিকল্পনা করি, তখন যদি আত্ম-সন্মানের অর্থনীতি রচনা করতে না পারি তবে অর্থনীতির সূচক অনেক বৃদ্ধি পেলেও তা প্রকৃত উন্নয়ন হবে না। অর্থনীতির সূচকের উঠা-নামার পরিসংখ্যান এক অর্থে প্রবঞ্চনা, যদি তার বন্টনে ত্রুটি থাকে, আর তা ন্যায়বিচার পরিপন্থী হয়। জাতীয় অর্থনীতির সুস্থতা সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কযুক্ত।


(২) সে অর্থনৈতিক বৃহৎ প্রবৃদ্ধিতে কী যায় আসে যা্র ফল বেশির ভাগ মানুষ ভোগ করতে পারে না। ট্রিকেল ডাউন (চুঁয়ে পড়া) পদ্ধতিতে প্রান্তিক মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের ধারণা শোষণমূলক ও নির্যাতনমূলক মনে করা কি খুব অন্যায় ? মঙ্গল গ্রহে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে কার লাভ, যেখানে ৯৯.৯৯% মানুষের চিন্তা ভালোভাবে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার মতো সামান্য আয় রোজগারের? যখন ১% মানুষের হাতে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক সম্পদ, অথবা মাত্র ৮ জন সব চেয়ে ধনী ব্যক্তির কাছে যে সম্পদ তা পৃথিবীর সব চেয়ে গরীব মানুষের অর্ধেকের মোট সম্পদের সমান ?(Oxfam report,2017)

কিছু মানুষের নতুন শত-হাজার-লক্ষ কোটি টাকার কোটিপতি হওয়ার মধ্যে কী আনন্দ যদি, যখন ১৪ কোটি মানুষ কঠোর জীবন-সংগ্রামে লিপ্ত থাকে? তার চেয়েও বড় কথা কোটিপতি বা দরিদ্র্ কোনো মানুষই যখন সমাজে প্রকৃত মর্যাদা অর্জন করতে পারে না তখন ধন-সম্পদ অর্জন করেই বা কী লাভ। প্রকৃত মানব-উন্নয়ন একটু একটু করে এগিয়ে চলুক, কিন্তু তা যেনো হয় সত্যকারের, অর্থাৎ আত্ম-মর্যাদা- প্রবর্ধক সুচক হয়ে বেড়ে ওঠে। যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা মানুষে মানুষে ভালোবাসা, দয়া, মহানুভবতা্ ও আত্ম-ত্যাগের সুযোগ সৃষ্টি করে না, কল্যাণের সংস্কৃতির পক্ষে কাজ করে না তা সংকীর্ণ স্বার্থপরতা, অশুভ ও  চূড়ান্ত অর্থে ব্যর্থ।


(৩) কেউ বলবেন,  এখানে 'ক্যাটাগরি মিস্টেক' হচ্ছে। অর্থনীতি আর রাষ্ট্রনীতি বা সমাজ নীতি ও ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। জানি কোথায় পার্থক্য। কিন্তু অর্থনীতির শক্তি অন্যান্য নীতিগুলিকে সবেগে চালিত করতে পারে, এটিতো বোধগম্য? আমরা কোথায়,কীভাবে কতোটুকু জোর দিচ্ছি সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির বার্ষিক পরিকল্পনা কিন্তু সর্বগ্রাসী দূর্নীতির বিরুদ্ধে স্বয়ংক্রিয় ভাবে কাজ করতে পারে, যাতে করে বাজেটে বৈধ মুদ্রা-সংস্থান বহুগুণ বেড়ে যায়। 

কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রত্যয়টি এখনও তথাকথিত তৃতীয়/চতুর্থ ইত্যাদি বিশ্বে প্রধানত ধারণাগত। গণমানুষের কল্যাণ তথা নাগরিক কল্যাণ যেখানে মূখ্য বিষয় সেখানে এটিও জরুরি বার্ষিক পরিকল্পনায় দূর্নীতির ফাঁক-ফোঁকর বন্ধের নানা কলা-কৌশল সংযোজন করে দেয়া। তখন নীতির সঠিক প্রয়োগে রেমিটেন্সের পাহাড়সম রিজার্ভ ব্যালেন্স অলস পুঁজি আকারে পড়ে না থেকে অর্থনীতির নিয়মের বিভিন্ন কার্যকর পথে ঠিকই সচল হতো। বাজারে পুঁজি সঞ্চালন বেড়ে যেতো!

(৪) একজন উৎসুক হিসেবে ব্যাপারটা আমি এইভাবে দেখি। অনেকেই কার্ল মার্ক্সের 'পুঁজি'(দাস ক্যাপিট্যাল) নামের অসাধারণ বইটি যথাসাধ্য পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালইয়ের ছাত্র জীবনে এডাম স্মিথ, রিকার্ডো, কুজনেট, ম্যালথাসসহ আরও কিছু ক্লাসিকের মূল প্রতিপাদ্য সামান্য হলেও পড়েছি, ও যেটুকু পেরেছি অন্তর্দিষ্টিতে বুঝতে চেষ্টা করেছি। আমার শেখা অর্থনীতির অ-আ-ক-খ ভাষাবোধ ও তুলনামূলক জীবন-দর্শন থেকে শেখা নৈতিকতার বোধ থেকে- সেই অনুপ্রেরণায় লিখলাম। আমি অর্থনীতিবিদ নই, অর্থনীতির ছাত্রও নই। কাজেই অর্থনীতি বিষয়ক আমার ভাবনা-চিন্তার মধ্যে বিষয়ীগত আবেগ, অতিরঞ্জন ও কিছু একাডেমিক অস্পষ্টতা থাকতে পারে। তবে বিশ্বাস করি এতে কিছু সত্য নিশ্চয় আছে, যে সত্য আমাকে বলে দেয়, অর্থনীতিতে শুধু ইঞ্জিনিয়ারকেই নয়, কবিকেও দরকার। 

(পুরোনো লেখা।)


Comments

Popular posts from this blog

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস। -আইনুল বারী