আমাদের সন্তানদের বেড় ওঠা, আমাদের প্রত্যাশা । -আইনুল বারী

আমাদের সন্তানদের বেড় ওঠা, আমাদের প্রত্যাশা ।
-আইনুল বারী
- -- --  -

'প্রতিদিনের একটা চেনা-জানা পরিবেশ কল্পনা করা যাক...
যেখানে বাচ্চাকে রোজ সকালে মা টেনে তুলছেন ঘুম সম্পূর্ণ হবার বেশ আগেই।তাকে ধরে-বেঁধে কাঁধে বই-খাতার বিরাট স্তুপ চাপিয়ে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন।
বাড়ি ফিরে এক গাদা হোম টাস্ক।বলা উচিত পড়ানো না, গেলানো হচ্ছে তাকে। একটার পর একটা যন্ত্রনাদায়ক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে রাত দিন কীভাবে যেনো পেরিয়ে যাচ্ছে শিশুর।তার ঘুরে বেড়ানোর স্বাদ ফ্লাট বাসার পোল্ট্রি ফর্মের এক ভৌতিক খোপের মধ্যে আটকে আছে।
ওর মধ্যেই সে দৌড়াদৌড়ি করে। ওটাই তার খেলা। সেখানে তার কোনো যুক্তি নেই, শুধুই এলোমেলো দৌড় আর চিৎকার-হুল্লোড়। বিনোদনের সুযোগ পেয়ে যখন সন্ধ্যায় টিভিতে খেলা দেখতে বসে, আর দেশের টাইগাররা যখন চরম হতাশ করে, মাথা নিচু করে সাজঘরে ফেরে, ফুটবলাররা মালদ্বীপ ভুটানের কাছে অনবরত কুপোকাত হয়, কাবাডিতে হেরে গিয়ে দল মাথা নিচু করে সাজঘরে ফেরে, তখন আমাদের শিশুদের মনে হেরে যাওয়াটাই চিরকালের নিয়তি বলে মনে হয়।
কখনো, চঞ্চল বাচ্চারা শান্ত হয়ে টিভিতে কার্টুন,বা মায়ের সাথে হিংসা-বিদ্বেষের সিরিয়াল দেখতে বসে।সব চেয়ে ছোট শিশুরা, যাদের মায়েরা চাকুরি করেন,তাদেরকে বাসায় রেখে যান,তারা অবিরত আই-ফোন,ট্যাব ঘঁটে ঘেঁটে ভুলে যায় বাস্তব দুনিয়াটাকেই! তারা আটেস্টিক টেকনো-শিশু হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। মাকেও মনে হয় অচেনা দূর্বৃত্ত!
বাংলা সিনেমা-নাটকের নায়ক-নায়িকা-ভিলেনরা তরুণদেরকে জীবন সম্পর্কে ভাবনা চিন্তার এমন এক ক্লেদাক্ত জঘন্যতা শেখাতে চায় যে সে পুরোপেরি ভড়কে যায়।ফলে সে চোখ ফিরিয়ে নেয় বাংলা সিনেমার কদর্য সন্ত্রাস ও অশ্লীলতা থেকে। তখন হিন্দি সিনেমা্র রোমান্স ও ইন্দ্রিয় সুখবর্ধক গান তাকে কল্পনার আকাশে ভাসিয়ে নিয়ে যায় চুম্বক আর্কষণে। তাকে বাস্তব জীবন সম্পর্কে এক গাদা মিথ্যা কথা শেখায়। আর ভীষণ প্রেমকাতর করে তোলে। কল্পনার রাজ্যেই, জেগে থাকার পুরো সময় ঘুমিয়ে থাকতে বলে। অথবা মাদকাসক্ত করে রাখে।
আর বাইরে বেরুলেই শহরের রাস্তা শিশুকে রক্তচক্ষু মেলে ভয় দেখায়। রাস্তায়-পার্কে কদাচিত ঘুরতে যাবার সময় হর্ণ, হুইসেল, ধুলো ময়লা, জ্যাম, ঘাম সব মিলিয়ে তার পিছে তাড়া করে আসে রাক্ষস-খক্কসের দল। মহল্লায় প্রকাশ্যে, বা টিভি চ্যানেলের সংবাদে সে দেখে কীভাবে এক অসহায় ছিঁচকে চোরকে জনতা গণ পিটুনি দিয়ে মেরে ফেলছে। কীভাবে ফতোয়াবাজরা গ্রামের অসহায় দুই মেয়েকে দল বেঁধে পেটাচ্ছে। আর তাকে ঘিরে অলস লোকের দল আনন্দ উপভোগ করছে, যেনো দারুণ এক মজা।
এ বর্বরতা সেন্সরহীন। শিশুকে ভড়কে দেয়া ভয় তাকে সারা দিন তাকে তাড়া করে ফেরে। তখন বিবশ বাচ্চারা সভ্যতা ও মানবতা কী জিনিশ শেখে না। বরং ভুলে যায় সবটুকু যাওবা একটু শিখেছিলো।এমন এক ভয় আর যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হয় তাকে, যে সে ভাবে এটাই তার মেনে নেয়ার জীবন। কিন্তু প্রতিদিনের শিক্ষা এখানেই শেষ নয়।
আমাদের সন্তানেরা মায়ের সাথে প্রতিবার মার্কেটে গিয়ে দেখছে ধোঁকাবাজ ব্যবসায়ীদের শয়তানিভরা চালাকি। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে দেখছে এক বিরল প্রজাতির কসাইদের। বাবা মায়ের সাথে সিএনজি উঠতে গিয়ে দেখেছে সিএনজি আলার মাস্তানের মতো কীভাবে ইচ্ছামাফিক ভাড়া চাইছে। রোজই দেখছে সে। মানুষে মানুষে ঝগড়া-মারামারি আর অশ্রদ্ধাবোধ। আর তার দিকে বড়দের নিরাপত্তাহীন হন্তরকের চাউনি।
ঘরের মধ্যেও বেড়ে ওঠা শিশু হঠাৎ পাপকে আলিঙ্গন করতে দেখে। বাবা মায়ের হাতে তুলে দেয় গর্বিত ভংগিতে বিস্তর টাকা, খাদ্য ও উপহার। তাদের মধ্যে ভালোবাসা নেই বুঝে গেছে। স্কুল ভর্তি, কোনো কাজ বাগাতে দু' নম্বরি করা হচ্ছে সে বোঝে ঠিকই।
টিভির সংবাদগুলো তাকে ধমক দিয়ে জানায় যেনো এক প্রকান্ড মেশিনের মধ্যে প্রতিদিন ষড়যন্ত্র তৈরি হচ্ছে। কেউ না কেউ কাউকে খুন করছে কোথাও। মাথা ফাটাচ্ছে কারো। আগুনে পুড়িয়ে মারছে। পুলিশ ধরছে। পেটাচ্ছে । ছিনতাই হচ্ছে দিবালোকে, টাকা-পয়সা-গহনা-পার্স অহরহ কেড়ে নিচ্ছে।
আমাদের শিশুরা সারাক্ষণ দেখছে ও শিখছে এসবই। বিশ্বাসঘাতকতা করে দল বদল করছে একে অন্যে। কোনো অপরাধবোধ নেই। অনুশোচনা নেই। ঘরের মানুষ ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। মানুষ ভীষণ খেপেছে সবাই সবার প্রতি। কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। আর লুকোতেও পারছে না কেউ কোথাও। সে রাজনীতিও বুঝে গেছে দ্রুত। আমাদের বাচ্চারা ঠিকই এসব বোঝে। কারণ তারা এখন বিরতিহীন শিখছে। যা পাচ্ছে তাই গোগ্রাসে গিলছে। হ্যাঁ গিলছেই উপযুক্ত শব্দ। কোনো কিছু গিলে ফেলার কাজটা সে সব চেয়ে ভালোভাবে পারে, কেননা সে বেড়ে ওঠা শিশু। সে বেড়ে উঠছে বড়দের তৈরি করা সমাজ-বাস্তবতায়।
তার স্কুলের সিলেবাস। খেলার জগত। বিনোদন, ঘর। শহরের রাস্তা।নিরাপত্তাবাহিনী বেষ্টনী। তার বন্ধবান্ধব হুল্লোর।তার ঘুমের ভিতর। সব কিছুর মধ্যে কোথাও সে এক দন্ড শান্তির কিছু দেখেনি। কোথাও যুক্তির শাসন দেখেনি। মানবতার স্নেহ অনুকম্পা,ক্ষমা সচারাচর দেখেনি। ন্যায়বোধ, আত্মমর্যদা- এসবের মর্মাথ ভালো করে বুঝে উঠার ফুসরত পায়নি। সে শুধু এক অনাকাংখিত এক চোখা রাক্ষসের দলের খোঁজ পেয়েছে। ভয়ংকর শত্রুতার গন্ধ চিনেছে। দৌরাত্ম, তান্ডব, দাপট, অহংকার, ঘৃণা- এ শব্দগুলি তার মুখস্ত হয়েছে।
আমাদের প্রজন্ম এভাবেই বাড়ছে বহু দিন ধরে!
----
কিন্তু তবুও আমি, মাঝে মাঝে এখন, দেখি ও ভাবি। আমাদেরই সন্তানরা কেউ কেউ অদম্য স্বপ্ন ও ভালোবাসা নিয়ে পথে নেমেছে। পথ শিশুদের পড়ালেখা শেখাচ্ছে।সবুজ গাছ লাগাচ্ছে। দুস্থদের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে। পাখির জন্য বাসা বেঁধে দিচ্ছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ফেসবুকে ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। তখন মনে হয়, না,এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি।

(আমার পুরোনো লেখা থেকে সংগৃহীত )

Comments

Popular posts from this blog

ঠগ, ঠগী কারা? ঠগবাজি কী?- বিকল্প ইতিহাস -আইনুল বারী

ক্ষমতার তত্ত্ব-তালাশঃ অবিশ্বাসের দর্শন বনাম বিশ্বাসের দর্শন

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগে ভারতবর্ষে ও চীনে মাদক বাণিজ্যের জাল ও বৃটিশ পুঁজির পুঞ্জীভবনঃ ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ণের এক টুকরো ইতিহাস। -আইনুল বারী